বিথঙ্গল ঘুরে: ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললো নৌকা। সবে শ্রাবণের শুরু।
মাঝে মধ্যে দ্বীপের মতো গ্রাম, কোথাও একটা বাড়ি নিয়েই দ্বীপবাড়ি জেগে আছে হাওরসম ডুবো ক্ষেতের ওপরে। একটা বিশাল হিজল গাছ ডালপালা ছড়িয়ে যেনো জেঁকে বসে আছে অর্ধেকটা শরীর পানিতে ডুবিয়ে।
অগ্রহায়ণে জমি জেগে গেলে হাইব্রিড ধানের চাষ হবে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত একফসলি জমিতে। মাঘ মাসে পেকে গেলে সেই ধান কাটতে আসে রংপুর অঞ্চলের শ্রমিকরা। বিঘা প্রতি ৩/৪ মণ ধানের বিনিময়ে মজুরি শোধ হবে তখন। জ্যৈষ্ঠ থেকে ফের পানিতে তলিয়ে যেতে থাকবে হাওর তীরের জমি।
ঘণ্টা দুই চলার পর উত্তাল হয়ে উঠলো হাওর পাড়ের জলা। দক্ষিণ থেকে আসা জোর বাতাসে টালমাটাল ইঞ্জিন নৌকা। কয়েক ফুট পানিতেই এতো ঢেউ যে হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। নৌকার খোলে ধাক্কা খেয়ে গলুইয়ের উপরে ছিটকে আসছে ঢেউয়ের আগা।
বাঁয়ে পৈলারকান্দি আর ডানে বিথঙ্গলের মাঝ দিয়ে আসা বাতাস মনে হয় উল্টে দেবে নৌকাটাকে।
শেষতক অবশ্য কোনো বিপদ ছাড়াই বিথঙ্গল ঘাটে ভিড়লো আশরাফুরের নৌকা। মাঝে থই থই পানিতে দুই ভাগ হয়ে আছে বিথঙ্গল গ্রাম। শুকনো মৌসুমে পানি নেমে গেলে একটাই গ্রাম হবে দুই দ্বীপ মিলে।
জগদানন্দ স্কুল ঘাটে ভিড়লো নৌকা। পিচ্ছিল পথ বেয়ে উঠে বাজারের পথ ধরতেই বিশাল পুকুর। তার পাড়ে বিথঙ্গল আখড়া্। বিশাল চৌকোনা চত্বর ঘিরে রেখেছে মুঘল কাঠামো। তাতে সারি সারি ঘর। সব মিলিয়ে ১২০টি। মাঝে উন্মুক্ত চত্বর। পুরনো অনেক ঘরের দেয়াল-ছাদ ধসে গেছে।
এই আখড়া বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থস্থান। এ আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী।
উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থ ঘোরার পর ষোলো শতকে এখানে ঘাঁটি গাড়েন রামকৃষ্ণ গোস্বামী। তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মাণিক্য বাহাদুর প্রাচীন নির্মাণ কৌশল সমৃদ্ধ দু’টি ভবন নির্মাণ করে দেন। এ আখড়ায় সস্ত্রীক এসে প্রায়ই অবস্থান করতেন তিনি। পরে রামকৃষ্ণ গোম্বামীর সমাধিস্থলে আধুনিক নির্মাণ কৌশল সমৃদ্ধ ভবন তৈরি করা হয়।
চালা আকৃতির ছাদের সেই ভবনের একপাশে রাখা শ্বেত পাথরের চৌকিটির ওজন ২৫ মণ। আরো আছে পিতলের সিংহাসন, নকশাখচিত প্রাচীন রথ এবং রুপার পাখি ও সোনার মুকুট।
আখড়ার পাশেই বাড়ি কীর্ত্তনগায়ক সুকুমার দাস মোহন্ত গোস্বামীর। তিনি জানান, রামকৃষ্ণ গোস্বামীর অনুসারীরা জগমোহিনী সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। সারা দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ আছে এ সম্প্রদায়ে। নির্বাণ সঙ্গীত নামে তাদের এক স্বতন্ত্র সঙ্গীত ধারাও আছে।
১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ আছে এ আখড়ায়। তাদের গোসলের জন্যই আখড়া লাগোয়া বিশাল পুকুর কাটা হয়।
কার্তিক মাসের শেষ দিন ভোলা সংক্রান্তি উপলক্ষে কীর্ত্তন হয় এখানে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোল পূর্ণিমার ৫ দিন পর উদযাপন হয় পঞ্চম দোল উৎসব। এছাড়া চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে হয় পূণ্যস্থান। স্নানঘাটে বসে বারুনী মেলা। রথযাত্রা হয় আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে।
এখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে দিলির আখড়া নামে আর একটি আখড়া আছে এই সম্প্রদায়ের।
বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে বিথঙ্গল আখড়ার দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। শুকনো মৌসুমে হবিগঞ্জ কামড়াপুর ব্রিজ থেকে জিপে সুজাতপুর, তারপর নৌকোযোগে অথবা পায়ে হেঁটে আসা যায় এখানে। বর্ষা মৌসুমে আসতে হয় হবিগঞ্জের রত্না ঘাট অথবা বানিয়াচং আদর্শবাজার থেকে। রত্না ঘাট থেকে আসতে সময় লাগে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা। ইঞ্জিন নৌকার ভাড়া দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আখড়া দর্শন শেষে আশরাফুরের নৌকা এখন রত্নাঘাটেই ফিরবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৬
জেডএম/
** হারিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা
**সাত শতাব্দীর সাক্ষী শঙ্করপাশা মসজিদ
**চুন ব্যবসায়ীর ঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে
** চুরি গেছে মুড়ারবন্দরের শিলালিপি
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে