বানিয়াচং ঘুরে: হবিগঞ্জ শহর থেকে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রামে যাওয়ার রাস্তায় ডজনখানেক নড়বড়ে বেইলি ব্রিজ। গাড়ি যাওয়ার সময় লোহার পাতে ট্রেনের মতো আওয়াজ ওঠে।
উপজেলা সদরে ঢোকার মুখেই হাতের বাঁয়ে পড়লো বিবির মোকাম। আদি কাঠামোতে মুঘল ঐতিহ্য জ্বলজ্বল করছে। মসজিদের সামনে বাঁধানো চত্বর, তার সামনে আনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পুরনো ফটক। চৌকোনা ফটকের উপরে পরগাছা জন্মালেও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য মোটামুটি অটুট। যদিও ধসে গেছে পাশের দেওয়াল।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের উত্তর পাশে মুঘল রীতিতে নির্মিত বিবির সমাধিও দর্শনীয় বটে।
মুঘলরা যখন বাংলায় আসে তখন বানিয়াচং ছিলো বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম আনোয়ার খাঁ’র রাজধানী।
সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে আনোয়ার খাঁ ও তার ভাই হুসেন খাঁ’র সঙ্গে মুগলবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে খুব সম্ভব মুঘল রীতিতে মসজিদ নির্মাণের চল শুরু হয় এখানে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, একদা পুটিয়াবিল নামে বিশাল এক জলাশয় ছিলো এখানে। সেখানে চাঙ বানিয়ে পাখি শিকার করতেন বানিয়া নামে এক দক্ষ শিকারি। সে থেকেই এই বানিয়াচং নাম।
কিন্তু একটা উপজেলা সদর কি করে গ্রাম হয়? তাও আবার বিশ্বের সবচেয়ে বড়! সে প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া গেলা বানিয়াচং ঘুরে।
সাধারণত কোনো শহরে বাড়ির ফাঁকে গাছপালা থাকে, কিন্তু বানিয়াচং সদরে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িঘর। গোটা শহরে চারতলা ভবন আছে একটি। গোটা কয়েক ৩ তলা ভবন। বেশিরভাগাই একতলা বাড়ি। থাকার জন্য কোনো হোটেল নেই বানিয়াচংয়ে। যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নৌকা।
উপরন্তু আয়তন এতো বড় যে বানিয়াচংকে চার চারটি ইউনিয়নে ভাগ করতে হয়েছে। ৪ ইউনিয়ন মিলে বানিয়াচং তাই হয়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম। এখানে মানব বসতি, বিল আর কৃষি ক্ষেতের অদ্ভুত এক মিতালি।
অথচ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন সাক্ষী দিচ্ছে গৌরবময় ইতিহাসের। বড় বাজারের পাশে বটগাছসহ লতাগুল্ম মাথায় নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে বানিয়াচং রাজবাড়ীর ভগ্নপ্রায় একাধিক কক্ষ, দেয়াল। বিশাল অংশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে দেওয়ান আলী রাজা ওয়াকফ স্টেটের পুকুর, জমি।
বড় বাজার মসজিদ ছাড়াও কালিকাপুরে আদি কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরো পুরনো মসজিদ, শিব মন্দির। পুরানবাগ মসজিদে তো রীতিমতো একটা শিলালিপিই পাওয়া গেলো। কিছুটা সংস্কার হলেও এখনো স্পষ্ট আদি কাঠামোর নিদর্শন।
শহর ছাড়িয়ে সাগর দিঘি, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুকুর। তার শান্ত জলে মিশে আছে রানি কমলাবতীর আত্মবিসর্জনের উপাখ্যান। কালজয়ী উপাখ্যান আলাল-দুলাল, রানি ভবানী, আমেনা সুন্দরী, আফজাল খান ও আরজু বানুর স্মৃতি তো এই উপজেলার পরতে পরতে।
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি আর সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছে এখানকার লোকজ জীবনধারা। কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ঘেঁটুপুত্র কমলাকে নিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তারও সৃষ্টি নাকি এই বানিয়াচংয়েই।
ঘেঁটু গান ছাড়াও আইড়ি (আরি), আন্নি ও পালা গানের মতো প্রাচীন লোকগানের ঐতিহ্য এই বানিয়াচং এরই। এ এলাকায় আরো আছে মালজোড়া (গানের লড়াই), বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, জারি, সারি, গীত, ধামাইল ও ভাটিয়ালি গানের ঐতিহ্য। বানিয়াচং এর মরমি গায়ক-সাধক আর কবিদেরই সৃষ্টি এসব অমর গাথা।
বর্তমান বানিয়াচংয়ের উত্তরে সুনামগঞ্জের দিরাই, সাল্লা ও আজমিরিগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণে হবিগঞ্জ সদর ও লাখাই উপজেলা, পূর্বে হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিমে আজমিরিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা। এই গ্রাম উপজেলার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য। ছড়িয়ে আছে নানারকম নির্দশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৬
জেডএম/
** জগমোহিনীদের বিথঙ্গল আখড়ায়
** হারিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা
**সাত শতাব্দীর সাক্ষী শঙ্করপাশা মসজিদ
**চুন ব্যবসায়ীর ঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে
** চুরি গেছে মুড়ারবন্দরের শিলালিপি
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে