লাউড়ের গড় ঘুরে: এ এমনিতেই এ এলাকায় বছরে ৫ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। তারওপর আজ আকাশের মন বড় বেশি খারাপ।
ক্রমাগত ভাঙনে ১০০ মিটার প্রস্থের মূল নদী কয়েক গুণ বড় হয়ে গেছে এখানে। বিন্নাকালী বাজারে এখনো ভাঙনের ছোবল স্পষ্ট। বৃষ্টির বাগড়ায় রাস্তাঘাট মাখামাখি কাদাপানিতে। ওপাড়ের গড়কাঠি, বাদারঘাট, বড়ছড়া, টেকেরহাটে যাওয়া যাবে না এ আবহাওয়ায়।
অগত্যা পূণ্যাতীর্থ ধাম পেরিয়ে মূল লাউড়ের গড় বাজারে। স্বাভাবিকভাবে গড় মানে উঁচু এলাকা। তবে এ এলাকায় গড় মানে দুর্গ।
লাউড়ের গড় বাজার ঘেঁষেই কাঁটাতার। ওপাশে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে জেঁকে বসে আছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। সমতলের এতো কাছে আর কোথাও মেঘ জমে কি না কে জানে!
মেঘমাখা পাহাড়ের গায়ে অদ্ভূত সুন্দর সব ঝরনা, ছড়া। পাদদেশে শাহ আরেফিনের মাজার। প্রতি এপ্রিলে এখানে বসে পূণ্যাতীর্থ আর শাহ আরেফিনের মেলা। জমে ওঠে সব ধর্মের মানুষের মহামিলন।
পাহাড়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা যাদুকাটা নদী দু’ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশে ঢুকেই। বছরের এ সময়টায় সেকেন্ডে প্রায় ১৪০০ ঘনফুট পানি বয়ে যায় যাদুকাটার বুক বেয়ে। গভীরতা দাঁড়ায় ৮ মিটারে। বিশ্বম্ভরপুর আর তাহিরপুর পেরিয়ে জগন্নাথপুরে সুরমায় পড়ার আগে ৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে বারোমাসী প্রবাহের এ নদী। এর উৎসমুখের পাহাড়ি খাঁজে ডিম ফোটায় বিরল প্রজাতির মহাশোল।
অদ্ভুত সুন্দর এ নদীর রূপে মুগ্ধ হয়ে মাছ কাটতে কাটতে মনের ভুলে শিশু যাদুকে কেটে ফেলেছিলেন কোনো এক মা। সেই থেকে এ নদীর নাম যাদুকাটা, আর এক নাম রক্তি। ওপাশে কালাটেক নামেও ডাকা হয় নদীটাকে।
যাদুকাটার বুক বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পাথর আসে বাংলাদেশের সীমানায়। লাউড়ের গড় বাজার লাগোয়া নদী তীরে সেই পাথরের পাহাড়সম খামাল। ওপাড়ে চুনাপাথরের পাহাড়, কয়লা খনি।
এই জলধারায় মিশে আছে প্রতাপশালী এক রাজ্যের ইতিহাস। সেই রাজ্যের নাম লাউড়। ধারণা করা হয়, লাউড় পাহাড়ের ওপর ছিলো কামরূপের রাজা ভগদত্তের রাজধানী। আর সেই রাজধানী ছিলো দুর্গ ঘেরা। গোটা সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মতো এ এলাকাও একদা ছিলো আসামের কামরূপের অধীনে।
বৃহত্তর সিলেট বিভক্ত ছিলো লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তিয়া রাজ্যে। আর যাদুকাটার ওপাশে তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়ায় ছিলো লাউড়ের রাজা বিজয় সিংহের বাসস্থান। ওই এলাকা এখনো হাবেলি বা হাওলি নামে পরিচিত।
সুনামগঞ্জ জেলার বেশির ভাগ অঞ্চল এককালে সাগর গর্ভে ডুবে ছিলো বলে ধারণা করা হয়। সেই সাগরের নাম ছিলো কালিদহ। যুগে যুগে পাহাড় ধোয়া মাটি জমার পাশাপাশি ভূমিকম্পজনিত ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনে জেগে উঠেছে ভূখণ্ড। পাহাড় লাগোয়া জলাশয় পরিণত হয়েছে পললগঠিত সমভূমিতে।
ওই ধারণায় পালে হাওয়া দিয়েছে এখানকার শত শত হাওরের গঠন ও ভূগর্ভের চুনা পাথর আর কয়লা। টেকেরহাটে যে চুনাপাথর পাওয়া গেছে তা তো তৈরি হয়েছে সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবাল থেকে।
লাউড়ের গড়ে যেতে সুরমা ব্রিজের ওপর থেকে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে বিশ্বম্ভরপুরের রাস্তা ধরতে হবে। শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার এগোলে কারেন্টের বাজার। সেখান থেকে ডানের পথ ধরে আরও ৭/৮ কিলোমিটার এগুলে বিন্নাকালি বাজার। এর দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে লাউড়ের গড়। সিএনজি অটোরিকশায় ভাড়া পড়বে ১২শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা। সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক।
তবে বর্ষাকালে তাহিরপুরের সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে স্পিডবোট বা ইঞ্জিন নৌকায় লাউড়ের গড় যাওয়া যাবে। স্পিডবোটে খরচ পড়বে ৫/৬ হাজার টাকা। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। ইঞ্জিন বোটে খরচ এর অর্ধেক। তবে ঘণ্টাচারেক সময় লেগে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৬
জেডএম/
** বিশ্বের বৃহত্তম গ্রামে
** জগমোহিনীদের বিথঙ্গল আখড়ায়
** হারিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা
**সাত শতাব্দীর সাক্ষী শঙ্করপাশা মসজিদ
**চুন ব্যবসায়ীর ঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে
** চুরি গেছে মুড়ারবন্দরের শিলালিপি
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে