শ্রীমঙ্গল থেকে: দু'টি পাতায় একটি কুঁড়ি। চা গাছের ডালে ডালে ফুটে থাকা একেকটি সবুজ সতেজ ডগা ছিড়ে আনেন চা-শ্রমিকেরা।
তবে লক্ষীকান্ত পাক্কা হিসাবী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা হিসাব তিনি কষে দিলেন। ৫০টি ডগার ওজন ১০ গ্রাম খানেক হবে। তাতে এক কেজির জন্য লাগবে ৫ হাজার ডগা। আর ২৫ কেজির জন্য লাগবে ১ লাখ ২৫ হাজার ডগা। অর্থাৎ দিনে ১ লাখ ২৫ হাজার বার হাত চালাতে হয় একজন চা শ্রমিককে। দিনে টানা ১০ ঘণ্টা খাটলে এটা হয়তো সম্ভব। তাতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪টি করে ডগা ছিড়তে হবে।
চায়ের বাগানে লক্ষীকান্তের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সমান বয়সী। জানালেন যুদ্ধের বছর তার বয়স ছিলো ১০ বছর। যুদ্ধ যখন বেঁধে গেলো চাবাগানের অনেকের মতো সেও ভারতে গিয়েছিলো। যুদ্ধের পর সেখান থেকে ফিরে চা বাগানে কাজ নিয়েছে। ফলে ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেওয়া এই হিসাব একেবারে ফেলনা নয়।
তবে মানোর কাছে হিসাবের বালাই নাই। তিনি চা তোলেন। দিনভর তুললে ২৫ কেজি হয়। যার বিনিময়ে তার মজুরি ৮৫ টাকা মাত্র। এর থেকে ১৫ টাকা কেটে নেওয়া হয় রেশনের খাতে। রেশন মেলে তিন কেজি আটা। সে আটার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাই বাতুলতা। কিন্তু মানো কিংবা লক্ষীকান্ত কারোই সে নিয়ে অভিযোগ নেই।
সমতলের কোন গাঁও গ্রামে এখন দিনের মজুরি ৫০০ টাকার কম নয়। কি সে ধান কাটার শ্রমিক, কিংবা সব্জি ক্ষেতের কামলা। চা-বাগানে এই শ্রমিকের তার সারাদিনের মজুরী মোটে ৮৫ টাকা। যা দেশের অন্যান্য স্থানের শ্রমিকের তুলনায় প্রায় ছয় ভাগের একভাগ।
আর শ্রীমঙ্গল শহরে এই মজুরি অন্তত সাড়ে তিনশ' টাকা। যা চা শ্রমিকের মজুরির প্রায় চারগুন।
এসব চাবাগানের কোনও কোনওটি বলতে গেলে শহরের আধা কিংবা এক কিলোমিটার দূরে। এই সামান্য দূরত্বেই চা শ্রমিকেরা শিকার হয়ে চলেছে বছরের পর বছর।
লক্ষীকান্ত জানালেন, এই মজুরি সবশেষ বেড়েছে ২০১২ সালে। এরপর আর কোনো পরিবর্তন নেই। একই ৮৫ টাকায় তাদের দিনভর খাটুনি। লক্ষ্মিকান্ত এটাও মনে করেন না আগামী ৫-৭ বছরে এই মজুরি আর বাড়বে।
কারণ চা বাগানে মজুরি নিয়ে আন্দোলনের কোন লেশ ঠিক এই মূহূর্তে নেই। আর দীর্ঘ সাড়ে চার দশকের শ্রমিকের অভিজ্ঞতা কিংবা জীবনের ৫৫ বছরের চা বাগানের কাহিনী তাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে আন্দোলন না করে কখনোই তাদের মজুরি বাড়েনি।
মাত্র দেড় টাকা দিনমজুরিতে কাজ শুরু করেছিলেন যে শ্রমিক তার ৮৫ টাকার মজুরি নিশ্চিত করতে ৫-৭ দফা আন্দোলন করতে হয়েছে।
আন্দোলন কেন লাগে? এমনিতে মজুরি কি বাড়ে না? সে প্রশ্ন অবাক উত্তর লক্ষ্মীকান্তের, 'বাবুরা কি অত সহজে কিছু দেয়। '
সবশেষ মাধবপুরের ছয় বাগানের শ্রমিক একজোট হয়ে আন্দোলন করে, কাজ বন্ধ করে দিয়ে তবেই মজুরি বাড়িয়েছে।
তবে, লক্ষ্মী কিংবা মানোরা এই সামান্য মজুরিতেই খুশি। প্রাণখোলা না থাক, কেমন চলছে, সে প্রশ্নে স্মিত হাসিটি মুখে লেগেই থাকে এদের। তারা জানেই না এটা কম মজুরি। যতদিন পেনে দুটো দানাপানি পড়ছে ততদিন তা জেনে তাদের কাজই কী!
তবে মানো জানালেন তার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ছে। নিজের মতো মেয়েকে চা বাগানের কাজে টানতে চাননা। আর লক্ষ্মীর মত, মা-বাবা যখন আর কাজ করতে পারেনা, তখন কাজে না নেমে উপায় আছে।
বংশপরম্পরায় যাদের জীবন দুটি পাতা আর একটি কুঁড়িতে বাঁধা, তাদের সন্তানদের সে উপায় হয়তো নেই, কিন্ত মানোর মনবল যে তৈরি হয়েছ, আর ওই যে বলার সাহসটুকু হয়েছে মেয়েকে আনবো না এই কাজে। তাতে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে বৈকি।
লক্ষবার হাত চালিয়ে গোটা দিন টানা শ্রম দিয় সামন্য মজুরি পেয়ে তাতে আধাপেটা খেয়ে জীবন ধারণের কষ্ট যে আছে তা মানো কিংবা লক্ষীর মুখের হাসির পিছনেই লুকিয়ে থাকে। তাইতো তারা ছেলে-মেয়েকে কষ্ট করে হলেও লেখাপড়া শেখাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৬
এমএমকে/
** এক্সপ্রেস ট্রেনে স্ট্যান্ডিং সিটের যাত্রীরা