সুজানগর (বড়লেখা) আগর বাগান ও কারখানা ঘুরে: সুগন্ধি ভালোবাসেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ঈদ-উৎসব থেকে শুরু করে পূজো-পার্বনসহ বিভিন্ন সামজিক অনুষ্ঠানেও আতর কিংবা সুগন্ধির ব্যবহার দেখা যায়।
ইতিহাস বলছে, মুঘলদের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে আতরের ব্যবহার প্রচলিত হয়। পরবর্তীতে তা সার্বজনীনভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এখন যে কেউ সুগন্ধি ব্যবহার করে নিজেকে অন্যের সামনে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে চান।
আগর গাছের ছাল থেকে প্রথমে আতর তৈরি হতো। কালের পরিক্রমায় সেই সনাতন পদ্ধতি বিদায় নিয়েছে, এখন আগর গাছে নানা ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করে সুগন্ধিটি সংগ্রহ করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে আতর তৈরি হচ্ছে। এ জন্যে বিখ্যাত মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর গ্রাম।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, প্রায় ৪০০ বছর আগে এই গ্রামের ধূসর মাটিতে আগর গাছের চাষ শুরু হয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা আরও ব্যাপক পরিসর লাভ করেছে।
গ্রামটির ভেতরে মেঠোপথ কিংবা পাকা সড়ক ধরে এগোলে দু’পাশে চোখে পড়বে বাগানে সারি সারি আগর গাছ। বাড়ির আঙিনাতেও এ গাছ লাগিয়েছেন অনেকে।
আতর অতি মূল্যবান একটি সুগন্ধি দ্রব্য, যা প্রস্তুত হয় আগর গাছ থেকে, আর গাছটি এখানে জন্মে বলে কেউ কেউ সুজানগরকে ‘চিরসবুজ সম্পদের গ্রাম’ বলেও ডাকেন।
হাওর উপজেলা জুড়ী থেকে সড়ক পথে বড়লেখার দিকে এগোলেই পথে রতুলীবাজার। ওই বাজারের উত্তর দিকে চলে যাওয়া পাকা সড়কটিই সুজানগরের প্রবেশ পথ।
এগিয়ে গেলেই আগর গাছের বাগান, গাছের কোনোটার গায়ে দেখা যাবে হাজার হাজার ‘পেরেক’, দেখে হয়তো কেউ ভেবে বসতে পারেন- পেরেকের গাছ নাকি! তবে ভুলটাও ভাঙবে নিমিষে, একটু কাছে গেলেই।
স্থানীয় চাষি বাবুল মিয়া জানান, একটি আগর গাছের বয়স কমপক্ষে তিন থেকে চার বছর হলে সেটিতে পেরেক মারা হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও হয় কখনও কখনও। পেরেক লাগানো অবস্থায় সাধারণত তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এক পর্যায়ে গাছটিতে এক ধরনের ছত্রাক আক্রমণ করে।
‘এরপর কেটে ফেলে গাছের পেরেক মারার জায়গাগুলো থেকে বের হওয়া রক্তের মতো জমাট বাঁধা ঘনরস সংগ্রহ করা হয়। গাছের ওই রস থেকেই পরে তৈরি হয় সুবাসের আতর। তবে সেটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ’
আগর প্রস্তুতের বিস্তারিত তুলে ধরেন বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনছারুল হক।
তিনি জানান, প্রথমে বাগান থেকে গাছ সংগ্রহ করা হয়। পরে লোহাগুলো সরিয়ে লাকড়ির মতো কেটে তা কুচি কুচি করে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ন্যূনতম ১৫ দিন থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত ভিজিয়ে এগুলো নির্দিষ্ট পাত্রে জ্বাল দেওয়া হয়।
‘প্ল্যান্টের চুল্লিতে দিয়ে একই তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয় অন্তত ৮ থেকে ১২ দিন। এরপর সংযোগ দেওয়া হয় আরেকটি সিলিন্ডারে, সিলিন্ডারটিকে আরেকটি বড় প্রবাহমান পানি ভর্তি পিপার মধ্যে রাখা হয়। এখানে আগর তেলমিশ্রিত বাষ্প পানি অন্য পাত্রে গিয়ে পড়ে। আর পানি থেকে আগর তেল আলাদা হয়ে পানির ওপর ভেসে থাকে। অপর একটি পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া হয়। প্ল্যান্টটিতে জ্বাল দেওয়া শেষ হলে ওই পিপা থেকে সংগ্রহ করা হয় আতর। ’
বিজ্ঞান বলছে, অ্যাকুইলারিয়া ম্যালানেসিস (Aquilaria malaccensis) গোত্রের সুগন্ধি প্রদায়ক উদ্ভিদ আগর গাছ। চিরসবুজ দ্রূত বর্ধনশীল এ গাছ সাধারণত ১৫-৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ০.৬-২.৫ মিটার ব্যাসের হয়। এর ফুলটি সাদা রঙের। ফলও হয় গুঁটির মতো।
এ গাছ থেকে সংগৃহীত জাইলেম বা কাস্টল ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে পতঙ্গের সহায়তায় ছত্রাকের সংক্রমণের ফলে গাছ রেজিনযুক্ত গাঢ় বর্ণ হয়। যা কেটে কুচি কুচি করে রাখা হয়। এটিই অতি মূল্যবান, যাকে বলা হয় আগর উড।
আগর গাছ চাষি ও ব্যবসায়ী আনছারুল হক বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটিই গাছের ভেতরে হয়, ফলে আগর উডের উপস্থিতি বাইরে থেকে অনেক সময় বোঝা যায় না। তবে গাছের এই জিনিসটাই সবচেয়ে দামি। এক কেজি আগর উড দেড় থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি হয়। বাইরে এর দাম হয় ১০ হাজার মার্কিন ডলার।
‘‘আমাদের এখানে তাড়াতাড়ি ফল পেতে পেরেক পদ্ধতি ব্যবহার করেন চাষিরা। তবে পেরেক মারা ‘উড’ গুণসম্পন্ন নয়। ’’
তিনি বলেন, আগর গাছের ডাস্টটিও (ছোট টুকরা) বিদেশে রফতানি করা হয়। এটি প্রসেসিং করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ আরও ২০-২২টি আইটেম তৈরি করে।
রফতানি প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী জানান, এক তোলা ভালোমানের আতরের দাম ৮-১০ হাজার টাকা। তবে স্থানীয় বাজারে তা সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়। এর সর্বনিম্ন দাম পড়ে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
আতরের উৎপাদন বিষয়ে আনছারুল হক বলেন, এক ডেকচির (জ্বাল দেওয়ার পাত্র) প্রতিটি প্ল্যান্ট থেকে এক থেকে দেড় তোলা আতর আসে। আর এ ধরনের ৩০টি প্লান্টে প্রতিমাসে সর্বোচ্চ ১০০ তোলা আতর পাওয়া যায়।
আগর খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের সহযোগিতা পেলে অদূর ভবিষ্যতেই সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে আতর রফতানির মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূল্যবান আগর গাছের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রেইন ফরেস্টে। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত ও ভুটানে এর চাষ হয়।
আর বাংলাদেশে সুজানগর ছাড়াও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আগর গাছের চাষ করেন অনেকে। তবে বেশি জন্মে সুজানগরের আশপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার পাথারিয়া পাহাড়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৬
এমএ/এইচএ/
**‘যন্ত্র-দেয়াল’ ভাঙছে সিলেটের ‘ওসমানী শিশু উদ্যান’
** এখনও সময় জানায় আমজাদের সেই ঘড়ি
**পর্যটন বর্ষের প্রচারণা নেই মাধবকুণ্ডে
** ঝরনার পাহাড়ে ফাটল, সতর্ক হোন
**জাফলং পর্যটনে বাধা ‘সড়ক’
**অযত্নে-অবহেলায় আদিত্যপুর গণকবর
**যাত্রীর ইয়ার্ডে পাবলিকের কার পার্কিং
** ফাংশন নেই শায়েস্তাগঞ্জ জংশনে
** সন্ধ্যে হতেই দোকান উঠে যায় বানিয়াচং বাজারে
** দু’টি পাতার একটি কুড়ির নিচেই অন্ধকার
** পর্যটনে আকর্ষণ তারাও
** স্বচ্ছ লেকে লাল শাপলার নিমন্ত্রণ
** ‘মৌলভীবাজার রুটের অধিকাংশ যাত্রীই পর্যটক’