লোভাছড়া (কানাইঘাট) ঘুরে: পাহাড়ি ঢলকে এরা বলে জোয়ার। সেই জোয়ারে টইটুম্বুর সুরমার বুক।
এমন বর্ষা চলতে থাকলে কয়েক দিনেই ঘোলা জলের নিচে চাপা পড়বে দুই কূল। পশ্চিম দিকে কানাইঘাট বাজার তখন তলিয়ে যাবে পানির নিচে। পূর্ব দিকে পলি জমা পাড়ে সবে মাথা তুলছে আমনের চারা। মাচা ভরে লকলক করছে লাউয়ের ডগা। মেঘালয় পাহাড় শ্রেণিতে বৃষ্টি হচ্ছে ক’দিন ধরে।
লাউমাচাসহ আমন ক্ষেত ডুবে যেতে সময় লাগবে না বুঝি। পাহাড়ি ঢল নামলে কয়েক ফুট পানির নিচে চলে যাবে নদীর পাড়। তারপর পানি নেমে গেলে ক’দিনের মধ্যে ফের ফিরবে আগের রূপে।
থই থই মাঝ নদীতে উজান বাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। শামসুল আলমের নৌকার কোর্স তাই তীরের কাছাকাছি থেকে সেট করা। হাল তুলে দিয়েছেন ১৪ বছরের কিশোর ছেলের হাতে।
পৌনে ১ ঘণ্টা উজান বাওয়ার পর নদী সঙ্গমে চলে এলো ইঞ্জিন বোট। ডানের বাজারটার নাম লোভার মুখ বাজার। উত্তরের সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোভাছড়া নদী এখানে এসে মিশেছে পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আসা সুরমার সঙ্গে।
এবার পূর্ব দিকে সীমান্ত বরারব মেঘালয় পাহাড় শ্রেণি অভিমুখে এগোতে থাকলো ইঞ্জিন বোট। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা পাহাড় শ্রেণীকে দূর থেকেই মোহনীয় লাগছিলো। এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেনো আরও নিজেকে মেলতে শুরু করলো পাহাড় শ্রেণী।
ভারতের সীমান্ত পেরুনোর পর সুরমায় পড়ার আগে মাত্র কয়েক কিলোমিটার প্রবাহ তৈরি করেছে লোভাছড়া। গড়িয়ে গড়িয়ে পাথর আসে এ নদীতে। নদী তল তাই পাথরময়। আর এ কারণেই এখানে পানির রঙ স্বচ্ছ নীল। সেই পানিতে আকাশের নীলের প্রতিফলন এক অবর্ণনীয় রূপের ডালা মেলে ধরে। পানির কয়েক ফুট নিচে তলদেশ পর্যন্ত দৃষ্টি চলে তখন।
কিন্তু এখন পাহাড় ধোয়া পানিতে জল ঘোলা বলে পানির নিচে দৃষ্টি গেলো না। আকাশ ধরা দিলো না পানির আয়নায়। চোখে ভাসলো না পাথরময় নদী তল।
ছোট্ট এ নদীর আকৃতি অনেকটা কাস্তের মতো। কাস্তের বাঁকানো অংশটা পেরিয়ে হাতলের ভেতরে ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে নোনডা খাল। উজানে লোভাছড়ার তীরে বাগান ঘাটে বসা বাজারটায় লোকসমাগম কম।
নৌকা ঢুকলো নোনডা খালে। শুকনো মৌসুমে হাঁটু পানি থাকলেও এই খাল এখন টইটুম্বুর। একটু এগোতেই দু’পাশে পড়লো সবুজ টিলা। গোমড়ামুখো আকাশের নিচে বৃষ্টি ধোয়া সবুজ পাহাড় থেকে যেনো বিচ্ছুরিত হচ্ছে সবুজ আভা।
আর একটু এগোনোর পর নৌকা এসে ঠেকলো ঝুলন্ত ব্রিজে। নোনডার খালের উভয় পাশে চা বাগান। ১৯২৫ সালে এই ব্রিজ তৈরি করেছিলো ব্রিটিশরা। স্থানীয়ভাবে লালরঙা এই ব্রিজটার নাম লটকনির পুল। গোটা ব্রিজটাই মোটা তারের ওপর ঝুলছে। ব্রিজের পাটাতনে দু’পাশে লোহার পাত আছে বটে, তবে মাঝের অংশটা ফাঁকা। সেই ফাঁকা দিয়ে উঁকি মারছে বর্ষায় বাড়বাড়ন্ত নোনডা খালের পানি।
একটু হাঁটলেই নড়ে ওঠে ঝুলন্ত ব্রিজ। তবে এই ব্রিজ এখনও ৩ টনি ট্রাকের ওজন বইতে পারে বলে জানা গেলো চা বাগানে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে।
ব্রিজের ওপরে উঠে আসতেই চোখের সামনে ঝুলে এলো পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়ের পর্বত শ্রেণী। কয়েকশ’ মিটার সামনেই ভারতের সীমান্ত। সেখানে এক পাহাড়ের পেছন থেকে উঁকি মারছে আর এক পাহাড়। আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়গুলোর খাঁজে খাঁজে থেমে যেনো বিশ্রাম নিচ্ছে দিনমান ছোটা মেঘের দল। লাউড়ের গড়ের মতো এখানকার মেঘগুলোও সমতলের অনেক কাছাকাছি বলে মনে হলো। যেনো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে মেঘের ভেলা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫১ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৬
জেডএম/
** ফ্যাসা বাঁশ, ডে ফল আর ভ্যাট-শালুকের বাজারে
** বৃষ্টির দেশ লালাখালে আকাশ ভাঙা বর্ষা
** রাজবাড়ি ভেঙ্গে বাজার, পুকুর ভরে বাড়ি
** লাউড়ের গড়ে বৃষ্টির বাগড়া
** বিশ্বের বৃহত্তম গ্রামে
** জগমোহিনীদের বিথঙ্গল আখড়ায়
** হারিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা
** সাত শতাব্দীর সাক্ষী শঙ্করপাশা মসজিদ
** চুন ব্যবসায়ীর ঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে
** চুরি গেছে মুড়ারবন্দরের শিলালিপি
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
** বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
** তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
** ৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
** ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে