সিলেট ঘুরে: পাহাড়, হাওর আর বনের বৈচিত্র্য বিছিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আলোকিত করে রাখা সিলেটের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা মত, মিথ আর উপকথা। এগুলোর কোনোটি হয়তো ধর্মীয় ইতিহাস থেকে উঠে আসা, কোনোটি আবার সম্পর্কিত স্থানীয় লোককাহিনীর সঙ্গে।
সবচেয়ে প্রচলিত ধারণাটি হলো, শিলা মানে পাথর। আর পাথরের প্রাচুর্যের কারণেই এ এলাকার নাম সিলেট। এ ধারণার পালে আর একটু হাওয়া দিয়ে বলা হয়ে থাকে, সিলেট শব্দের অনুসর্গ সিল মানে শীল বা পাথর আর উপসর্গ হেট মানে হাট বা বাজার। প্রাচীনকাল থেকে এ জেলায় পাথর ও হাটের আধিক্য থাকায় শব্দ দু’টি মিলে সিলেট নামের উৎপত্তি।
হিন্দু মিথ বলছে, কন্যা শীলাদেবীর নামে হাট স্থাপন করেন প্রাচীন গৌড়ের রাজা গুহক। তখন শিলার নামের সঙ্গে হাট জুড়ে নাম হয় শীলাহাট। কালক্রমে শিলাহাট থেকে সিলট, সবশেষে সিলেট নামটি টিকে যায়।
পুরাণে বলা হচ্ছে, বিষ্ণু চক্রে খণ্ডিত সতীর শবদেহের যে ৫১টি খণ্ড উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় তার মধ্যে দু’টি পড়ে সিলেটে। যেহেতু সতীর অপর নাম শ্রী। তাই এই শ্রী এর সঙ্গে হড্ড (হাড়) জুড়ে নাম হয় শ্রীহট্ট। যা পরে সিলেট নামে পরিচিতি পায়। বিষয়টাকে এভাবেও বলা যায়, শ্রী অর্থ প্রাচুর্য বা সৌন্দর্য, হস্ত অর্থ হাত। যেখানে শ্রী এর হস্ত পাওয়া গিয়েছিল তাই শ্রীহস্ত- যা কালের বিবর্তনে শ্রীহট্ট নাম ধারণ করে।
তবে হজরত শাহজালালের (র.) ‘সিল হট যাহ্’ আদেশ থেকে সিলেট নামের উৎপত্তি বলেও ধারণা প্রচলিত আছে। সিলেটে আসার সময় পথে অনেক বড় বড় পাথর পড়ায় শাহজালাল আদেশ করেন-সিল হট যাহ (পাথর সরে যা)। ওই আদেশে পাথর খণ্ড সরে গেলে সিলহট নামটির জন্ম হয়, যা পরে সিলেট নামে পরিচিতি পায়।
শ্রীহট্ট শব্দের আর এক নাম সমৃদ্ধ হাট। এই সমৃদ্ধ হাট বহু আগে থেকেই ছিলো বর্ধিষ্ণু বাণিজ্য কেন্দ্র।
প্রাচীন যুগে শ্রীহট্ট নামে প্রতিষ্ঠিত পৃথক রাষ্ট্র কিছুকালের জন্য ‘হরিকেল’ নামেও পরিচিত ছিলো। সপ্তম শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারত ভ্রমণের সময় এ এলাকাকে ‘শিলিচট্রল’ বলে উল্লেখ করেন।
ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে সিলেট এলাকায় মানুষের বসবাস বাড়তে থাকে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে গৌড় গোবিন্দকে পরাজিত করে হজরত শাহ্জালাল সিলেট অধিকার করলে সিলেট চলে আসে মুসলমান সুলতানদের অধীনে।
সুলতানি আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ। মহারাজা শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, দশম শতাব্দীতে বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজত্বকালে তিনি এ জেলা জয় করেছিলেন। তার অধীনে শ্রীহট্টমণ্ডল নামে প্রশাসনিক বিভাগ গড়ে ওঠে যা সামন্ত রাজাদের হাতে শাসিত হতো। এই শ্রীহট্টমণ্ডল থেকেই কালক্রমে শ্রীহট্ট বা সিলহেট, সবশেষে সিলেট নামের উৎপত্তি।
একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম পরিব্রাজক আল্ বেরুনির কিতাবুল হিন্দ গ্রন্থে সিলেটকে ‘সীলাহেত’ বলে উল্লেখ করা হয়।
ইংরেজ আমলেও কাগজ-পত্রে সিলহেট নামটির ব্যবহার ছিলো। তবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কাছাড় ইংরেজ অধিকারে এলে সেখানকার সদর স্টেশন শিলচর এর সঙ্গে পার্থক্য দেখাতে সিলহেট নামটিকে বেশি করে প্রচার করা শুরু হয়।
ভৌগলিকভাবে মেঘালয়, খাসিয়া, জৈন্তিয়া আর ত্রিপুরার পাহাড়ের মাঝে বন ও বালুকাময় টিলার বিস্তৃত হাওরপূর্ণ এলাকাটিই বৃহত্তর সিলেট এলাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে, সুরমা-কুশিয়ারাসহ মোট ৪৪টি নদী বয়ে গেছে বৃহত্তর সিলেটের বুক চিরে। এগুলোর মধ্যে ১৮টিই সীমান্ত নদী-যেগুলো নেমে এসেছে খাসিয়া, জৈন্তা অথবা মেঘালয় পাহাড় থেকে।
নদীবেষ্টিত এ জেলায় রয়েছে অনেক হাওর-বিল, ছোট বড় টিলা। টাঙ্গুয়া আর হাইল হাওরের মতো নয়নকাড়া হাওর ছাড়াও দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির অবস্থান সিলেটে। আছে, রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি আর লাউয়াছড়ার মতো অরণ্য, রাতারগুলের মতো জলাবন।
ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত সিলেট প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদেও সমৃদ্ধ। এখানকার মাটি চা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, চুনাপাথর, কঠিন শিলা, বালুসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। (সংকলিত)
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৬
জেডএম/