লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে ফিরে: রেল লাইন লাগোয়া টিলায় মাগুরছড়া পুঞ্জি (খাসিয়া পল্লী)। একটি শান বাঁধানো সিঁড়ি সোজা টিলার উপর পুঞ্জিতে গিয়ে উঠেছে।
রেল লাইন থেকেই দৃশ্যমান লোহার গেটে ছোট্ট সাইনবোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা পুঞ্জির নাম। ডান দিকে লাল কালিতে লেখা, ‘সংরক্ষিত এলাকা প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত-পুঞ্জি কর্তৃপক্ষ’।
পুঞ্জির ভেতরে সব রাজসিক কারবার। শান বাঁধানো সিঁড়ি, টিলার উপর সারি সারি দালান কোঠা। শোভা পাচ্ছে বিজ্ঞানের আর্শিবাদ ডিস অ্যান্টেনাও। বনজীবী এই ভূমিহীন পরিবারগুলোর রাজসিক জীবন কিছুটা ভাবনার স্লট তৈরি করে। কি করে এই রাজসিক জীবনযাপন সম্ভব! তাদের এতো বিলাসী জীবনের আয়ের উৎসইবা কি?
টুকটাক কথা হয় পথ প্রদর্শক গাইডের সঙ্গে। গভীর ভাবনায় হাবুডুবু খাওয়া দেখে গাইড বলেন, আপনার জন্য আরও চমক রয়েছে। ওই যে দেখেন গাড়ির গ্যারেজ। ওইটা এই পুঞ্জির মন্ত্রীর গ্যারেজ। তার দু’টি গাড়ি।
আগে ছিল ভাবনা, দু’টি গাড়ির কথা জানার পর দুর্ভাবনায় পড়ে যাই।
ঢাকা-সিলেট রেল লাইন দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে চলে গেছে। রেল লাইনের পূর্বদিকে সমান্তরালে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ পাকা সড়ক। সেই পাকা রাস্তার পূর্বদিকে মাগুরছড়া গ্যাস ফিল্ডের কাছাকাছি এই গাড়ির গ্যারেজটি। সেমিপাকা গ্যারেজের সামনে ঠিক মাঝামাঝিতে রয়েছে একটি পিলার। সেই পিলারের দুই দিকে দু’টি গাড়ির জন্য পৃথক কামরা।
২৩ জুলাই সকালেও সেডের সামনে পার্ক করা ১৯৯২ মডেলের নিশান পেট্রোল (ঢাকা মেট্রো ১১-৭৯৬৮) গাড়ি। গাইড জানালেন, আরও একটি জাপানি প্রাইভেট কার রয়েছে মাগুরছড়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিশন প্রধান সুচিয়ানের (করডর মন্ত্রী)।
কি করে কাগজে কলমে ভূমিহীন একজন বনজীবী দু’টি গাড়ি কেনেন! প্রশ্ন শুনে গাইড বলেন, আমাদের মন্ত্রীরাতো আমলাদের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। কিন্তু এই খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রীর হুকুম ছাড়া একটি গাছের পাতাও কেউ ছুঁতে পারবে না।
মন্ত্রীর আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে পান ও লেবু চাষ। বনের মধ্যে শত শত একর জমিতে রয়েছে পান। সেই পান বিক্রি করে মাসে লাখ টাকার বেশি আয় হয় তার। সমতলের মতো এখানে মাচা নয়, গাছ পেঁচিয়ে আকাশ পানে ওঠে পান লতা। ডালপালা বিহীন গাছ পান চাষের উপযোগী। সে কারণে বনের কোনো গাছের ডালপালা ছেঁটে পান লতা লাগিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। এরপর শুধু পান সংগ্রহ আর মাঝে মাঝে কীটনাশক স্প্রে করা। আর কোনো বিনিয়োগ নেই।
১৪৪টি পানে এক কান্তা। এমন ২০ কান্তা মিলিয়ে যে ২০ কুড়ি হয় তা ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা করে বিক্রি করে খাসিয়ারা। এ জন্য গাছকে পান চাষের উপযুক্ত করে তুলতে মরিয়া তারা। ফরেস্ট ভিলেজার নামে পরিচিত এই খাসিয়াদের ১৯৪০ সালে এখানে আনা হয়। খাসিয়াদের দাবি, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাদের এখানে নিয়ে আসে বন রক্ষার জন্য। তখন জীবন ধারণের জন্য সীমিত আকারে জুমচাষ করার অধিকার দেওয়া হয় তাদের।
কিন্তু বর্তমানে বনের চার-তৃতীয়াংশ জুড়ে চলছে পান ও লেবু চাষের রাজত্ব। নিভু নিভু করছে প্রকৃত বন। খাসিয়াদের লোভাতুর দৃষ্টি এখন অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিনিয়ত গাছের ডালপালা ও ডগা ছেঁটে দিয়ে তৈরি হচ্ছে পান চাষের ক্ষেত্র। আর সেই পান চাষ করে আয়েসী জীবনযাপন করছে খাসিয়ারা। বাদ যাচ্ছেনা স্থানীয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও।
তাদের এখনই নিবৃত করা না গেলে লাউয়াছড়ার ভবিষ্যত নিয়ে খোদ বন বিভাগের লোকজনও শঙ্কিত।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে মাগুরছড়ার মতো আরও একটি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। দুই পুঞ্জি মিলে ৬৩ পরিবারের আবাস। তাদের কাছে বনকর্মীরাও অসহায়। যাদের আবাস পুরো কোর এরিয়ায়। যেখানে কোন রকমের স্থাপনা থাকার কথা না। কিন্তু সংরক্ষিত এলাকাতেই প্রতিনিয়ত নতুন ভবন উঠছে খাসিয়াদের।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৬
জেডএম/