কাছাড়িয়া হাওর (সুনামগঞ্জ) ঘুরে: হাওর-বাওড়-নদীর দেশ বাংলাদেশ। নদীগুলো এদেশে বিছিয়ে আছে জালের মতো।
বিপুল পর্যটন সম্ভাবনার এ দেশে পর্যটন মানেই শীতকাল- এ ধারণা পাকাপোক্ত। নদী, ভাটির দেশের অমর কবি জীবনানন্দের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’ সত্যি সত্যি হবে যদি বর্ষায় একবার দেখা যায় বাংলার রূপ।
শীতে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিযায়ী পাখিকেন্দ্রিক যে পর্যটন অন্যসব পর্যটন সম্ভাবনাকে আড়াল করে রেখেছে বর্ষার কাছাড়িয়া হাওর উন্মোচন করতে পারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। সুনামগঞ্জ শহরে থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদর। শহর থেকে সুরমা ব্রিজ পেরিয়ে উত্তরে এগিয়ে পশ্চিমে মোড় নিলে দু’পাশে শুধু বিল আর হাওর। ব্রিজের টোল প্লাজা থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। বিশাল আয়তনের কাছাড়িয়া হাওর কোনো অংশে কম নয় টাঙ্গুয়া কিংবা হাকালুকি থেকে। অথচ একেবারেই অপরিচিত পর্যটকদের কাছে।
হাজার টাকায় সিএনজি অটোরিকশা কিংবা মাইক্রোবাস নিয়ে হাওরে পৌঁছার আগের প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তা পর্যটকদের আকর্ষণ করবে প্রথমেই। মসৃণ সুন্দর রাস্তার দু’পাশে বিল আর হাওর। মাঝে মধ্যে উঁচু এক চিলতে সবুজ ঘাসের জমিতে চরে বেড়াচ্ছে গরু, ছাগল আর হাঁসের দল। মাছ ধরছে বাড়ির ছোট্ট সদস্য থেকে শুরু করে সবাই। সবুজ টানেলের রাস্তাও দেবে বাড়তি আনন্দ। দূরে ততক্ষণে নজরে আসবে নৌকা বেয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে চলা অধিবাসীরা।
২৫টি হাওর আর ৯৮টি বিল অধ্যুষিত জগন্নাথপুর উপজেলার কাছাড়িয়া স্থানীয়ভাবে কড়চা নামেও পরিচিত। রাস্তা থেকে বসতবাড়িতে যাওয়ার বাঁশের সাঁকো, ভ্যাসাল জাল, জলাশয়ের ভিতরে মাছ পাহারা দেওয়ার টংঘর, চরে বেড়োনো হাঁস, সদস্যরোপিত ধানখেতে সাদা বকের ওড়াউড়ি, কুরা ঈগল কিংবা শঙ্খচিলের খাবার ভাগ করে নেওয়ার দ্বৈরথ দেখার এমন সুযোগ মিলবে এ পথে। এই আমাদের গ্রাম, এই আমাদের দেশ।
কাছাড়িয়া হাওরের আরও ছবি দেখতে ক্লিক করুন: বর্ষার কাছাড়িয়া
কাছাড়িয়া যাওয়ার তিন কিলোমিটার আগে কারেন্টের বাজারে শেষে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তা। পশ্চিমে চলে গেছে ঐতিহাসিক লাউড়ের গড়ের রাস্তা। দূরে সীমায় চোখ এড়ায় না ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় শ্রেণী। সে আরেক সুন্দর বাংলার গল্প। পূর্ব দিকে কাছাড়িয়া। হাওরের সীমানা যেখানে শুরু সেখানেই বাজার। পাড় বাঁধানো এ অংশে স্বচ্ছ পানির বড় বড় ঢেউ দোল খায় সানন্দে।
বাজারের নৌকাঘাট থেকে ঘণ্টাপ্রতি তিন-চারশ টাকায় ইঞ্জিন অথবা সাধারণ নৌকা ভাড়া করে ঘোরা যায় পুরো হাওর। আমাদের কিশোর চালক আজাদ বেশ আগ্রহ নিয়ে হাল ধরলো। ঘোরালো বিস্তীর্ণ জলরাশির হাওর, হাওরের দ্বীপগ্রামগুলো। উপজেলার একমাত্র খাদ্যগুদামটিও এ মৌসুমে হয়ে যায় দ্বীপের মতো। চারপাশে অথৈ পানি আর পানি।
উত্তরে কড়চা মাঝে ঘটঘটিয়া নদী আর পূর্বে সোনার হাওর। স্থানীয়রা জানালেন এমনটাই। বিশাল জলরাশির হাওরে দূর থেকে চোখে পড়ে একখণ্ড কালচে সবুজ ঢিবির মতো। কাছে গেলে এটাই হয়ে গ্রাম। মাটি খুব বেশি নেই। ১৫ থেকে ২৫ ফুটের বেশি হবে না গ্রামগুলোর ব্যাস। লম্বায় একেবারে কম নয়। কোথাও কোথাও ছিঁড়ে গিয়ে হয়েছে স্বতন্ত্র দ্বীপমতো। বাহাদুরপুর, শান্তিপুর, রায়পুর, ঘাগৈট, ফুলপরি, গোলাপপুরসহ ৪৮টি গ্রাম রয়েছে এ হাওরাঞ্চলে। প্রতি গ্রামের লোক সংখ্যাও ৭-৮শর বেশি না। সারা বছর তারা মেতে থাকে ভাঙা-গড়ার খেলায়। নৌকাই তাদের একমাত্র বাহন। মারা গেলে কাউকে দাহ করতে হলে চারপাশ পানিতে ডোবা উঁচু করে গেঁথে ওঠা শ্মশানই হয় তার গন্তব্য।
এখান থেকে ২ ঘণ্টায় নৌকায় যাওয়া যায় লাউড়ের গড়, যাদুকাটা নদী। সেখান থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর আর ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রা। সব মিলিয়ে ভোরে উঠে কোনো এক বর্ষাদিনে একদিনের হাওর ভ্রমণের পরিকল্পনা করাই যায়। ইদানীং প্রচুর সংখ্যক পর্যটক এ পথে আসছেন বলেই জানালেন মাঝি আজাদ। শীতে পরিযায়ী পাখিও প্রচুর সংখ্যক দেখা যায় এ হাওরে। তাই কম সময় হাতে নিয়ে যদি কেউ হাওর দেখার স্বাদ নিতে চান তাহলেও ঘুরে আসতে পারেন কাছাড়িয়া।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৬
এএ
** বৃষ্টিদিনে বৃষ্টির লালাখাল, নদীপাড়ের চা বাগান
** গাইডরাই চেনাবেন লাউয়াছড়া অভয়ারণ্য
** বানর-বেবুন-অজগর মানে না রেলের চাকা
** গাড়ির চাকায় পিষে যায় লাউয়াছড়ার প্রাণীপ্রাণ
** এক লেবুর দাম হাজার টাকা!
** সবুজের বুকে মোহময় শার্ফিন
** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-৪ (শেষ পর্ব)
** ছবিতে হাছন রাজার স্মৃতিবিজড়িত বসতবাড়ি
** ‘কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার’
** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-৩
** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-২
** হাওরের হাঁসে হাসি
** কাছাড়িয়া হাওরের পথে পথে-১
** মায়ার বাঁধনে মায়া, সঙ্গী জেমস-মনা
** এবার আসছে গৌরাঙ্গের সাত লেয়ারের জুস
** সবুজের বুক চিরে চেনা নতুন শ্রীমঙ্গল
** নাগা মরিচের আরও ছবি
** সাদা-কালো নাগা মরিচে গিনেস রেকর্ডের ঝাল
** তবু থেকে যায় সাতরঙা চায়ের রহস্য
** রাতদুপুরে সবুজবোড়ার রাস্তা পারাপারের দুঃখ
** পর্যটকবান্ধব নয় সিলেট-শ্রীমঙ্গলের ট্রেন
** চুলা নেই পূর্বাঞ্চলের কোনো ট্রেনের ক্যান্টিনে