খাগড়াছড়ি থেকে: চারপাশে পাহাড়ঘেরা সমতলের শহর খাগড়াছড়ি থেকে যখন আমাদের বাহন পানছড়ি চলেছে তখন ভোরের আলোয় হিমবাতাস। দূরের সবুজ পাহাড় ঘিরেছে পেঁজাতুলো মেঘে।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি এখন তীর্থস্থানের মতো। নামের সঙ্গে ছায়াঘেরা এ জায়গাটির সত্যি অদ্ভুত মেলবন্ধন। ১৯৯৯ সালে স্থাপিত এ কুটিরের প্রধান আকর্ষণ এখন বিশালকায় একটি বৌদ্ধমূর্তি। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় গৌতমবুদ্ধের মূর্তি। এমনটাই দাবি অরণ্য কুটির কর্তৃপক্ষের।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, প্রায় ১শ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত অরণ্য কুটিরে ২০০৪ সালে নির্মিত হয় এ বুদ্ধমূর্তিটি। সকাল সোয়া সাতটায় কুটিরের গেটে গিয়ে দাঁড়াতেই জানা গেলো আজ এখানে অনুষ্ঠান আছে। প্রবারণা পূর্ণিমার অনুষ্ঠান। এরইমধ্যে একদল নারীর দেখা মিললো যারা মাথায় তত্ত্ব নিয়ে পাহাড়ি থামি পরে সারিবদ্ধ হয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে ঢুকছেন কুটির কম্পাউন্ডের ভেতরে।
তাদের পিছ ধরে মিনিট তিনেক এগোতেই দেখা গেলা বিশালবপুর ধানমগ্ন অহিংস গৌতমবুদ্ধকে। তত্ত্ব নিয়ে চাকমা নারীরা সারিবদ্ধ হয়েই তিনবার ঘুরলো বুদ্ধের মূর্তি। তারপর আসনের কাছে বসে প্রণাম সেরে তত্ত্ব রেখে মানত পূর্ণ করে চললো ভান্তের মূল অনুষ্ঠানে।
শুক্রবার হওয়ায় ভেতরে ঢুকতে ও ঘুরতে কোনো সমস্যা নেই। সাধারণ দর্শনার্থীদের সকাল ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ঢোকার অনুমতি আছে। প্রতি শুক্রবার অনুষ্ঠান থাকে, শিশুদের পাঠদান করা হয়। তাই ঢুকতে পারে সবাই। তবে সাধনা কুটিরগুলো ভিতরে হওয়ায় এখন এ মূর্তি পর্যন্তই কেবল যাওয়ার অনুমতি মেলে।
এখানে ব্রত পালন করতে আসা উল্টাছড়ি ৫ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজয় চাকমার সঙ্গে দেখা ঘুরতে ঘুরতে। তিনি বলেন, বুদ্ধের এ মূর্তিটি সবার ভালোবাসার দান। এটি তৈরির সময় এলাকা ও এলাকার বাইরের কয়েক হাজার মানুষ টাকা দিয়েছে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন পানছড়ি অরণ্য কুটিরের উপাধ্যক্ষ শ্রীমত করুণাবর্ধন ভান্তে। তিনি এখন এখানে নেই।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বৌদ্ধমূর্তি দাবি করে তিনি বলেন, এটি তৈরির সময় আমরা শুধু আসনের নিচে ৬০ হাজার ইট দিয়েছি। পাশের পাহাড় থেকে পাথর বয়ে এনেছি। আশাপাশের ভক্তরাই এতে শ্রম দিয়েছে। কেউ টাকা নেয়নি। মূল কারিগর ছিলেন মায়ানমারের পুঁঞা মিস্ত্রি। আর এটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
একজন কেবল ১০ লাখ টাকা ছাড়া বাকি সবাই বিভিন্ন অংকের অর্থ দিয়েছে বলেই জানান তিনি।
৫০ ফুট উচ্চতার বিশাল এ মূর্তির ঠিক সামনে ডানপাশে রয়েছে সিবলী মহাস্থবির ও বামে উপগুপ্ত মহাস্থবিরের দুটি মূর্তি। বুদ্ধের বসার ভঙ্গি এখানে চিরায়ত, চিরচেনা। হাসিমুখে ধ্যানাসনে বাঁ হাত পায়ের উপর, ডান হাত তুলে শিষ্যদের উদ্দেশ্যে। ১২টি বিশাল স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো ছাদের তলে বুদ্ধের অবস্থান। সামনে মানত বা প্রার্থনা করার জায়গা, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর।
মূল্যবান আগরে ২০ হাজারের মতো গাছসহ বিভিন্ন মূল্যবান গাছ রয়েছে কুটির এলাকায়। তবে বুদ্ধের এ মূর্তিকে ঘিরেই এখন সব পরিকল্পনা, অনুষ্ঠান। প্রবারণা পূর্ণিমার অনুষ্ঠান সকালেই শেষ করলেও ঠিক একমাস পর কঠিন চিবর দান অনুষ্ঠানে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হবে বলে জানালেন এখানকার একজন তত্ত্বাবধায়ক সঞ্চয় চাকমা।
সব ধর্মের মানুষই এখানে আসেন বলে জানালেন তিনি। খাগড়াছড়ির অন্য সব পর্যটন কেন্দ্রের মতো ধর্মভিত্তিক পর্যটনকে এগিয়ে নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটা আরও বাড়বে বলেই মত শান্তিপুর অরণ্য কুটির সংশ্লিষ্ট সবার।
** পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার ‘সিস্টেমে’
** বাঁশের ভেতর মুরগি, পদের নাম ব্যাম্বো চিকেন
** পাহাড়ের সবুজ মাল্টায় দেশজুড়ে বিপ্লব
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৬
এএ