রামগড় (খাগড়াছড়ি) থেকে: ফেনী নদীর তীরে শরীর জুড়ানো বাতাসের দাপট। ওপাশে ত্রিপুরার সাব্রুম।
উত্তরে পানছড়ি আর মাটিরাঙার মধ্যবর্তী ভগবান টিলা বেয়ে নেমে আসা জলধারাই এই ফেনী নদী। যদিও ভারতের দাবি, এ নদীর জন্ম তাদেরই দেশে! বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াতেও বলা হচ্ছে, ‘ফেনী নদী ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রবাহিত হয়ে আলীগঞ্জ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে সীমান্তরেখা তৈরি করেছে। ’ আর উইকিপিডিয়া বলছে, ‘দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হওয়ার পর ফেনী নদী ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। ’
এমন গোলকধাঁধাঁয় পড়ে ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বিরোধ চলছে সেই ১৯৩৪ সাল থেকে। বিভিন্ন কারিগরি জটিলতায় এ নদীর পানির পরিমাণ এখন পর্যন্ত নির্ধারণই করা যায়নি। যদিও অনেক কিছু অমীমাংসিত রেখেই বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিটের জন্য এখন সেতু হবে ফেনী নদীর উপর। তাহলে ত্রিপুরা থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে ভারত।
১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী ভগবান টিলার বিভিন্ন ছড়া থেকে উৎপত্তির পরপরই বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতের ইজেরা গ্রামে প্রবেশ করেছে। এরপর দুই দেশের সীমান্ত ঘেঁষে কখনো বাংলাদেশ কখনো ভারত হয়ে বেশ কিছুটা অগ্রসর হয়ে মিরসরাইয়ের আমলীঘাটে ফের বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারপর ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী উপজেলা ছুঁয়ে পতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। গুগল ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
বৃহত্তর রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত তার বইতে লিখেছেন, তীরে গোচারণভূমি থাকায় পাবর্ত্য অঞ্চলের পাহাড়ি অধিবাসীরা ফেনী নদীর তীরেই গোচারণ করতে শেখে। এ অঞ্চলের আর সব নদীর পাহাড়ি পাড় খাড়া হওয়ায় সেগুলোর তীরে গোচারণভূমি নেই।
এই ফেনী নদীর নামকরণ নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মত। কেউ বলেন, ফনী রাজার নামানুসারে এই নদীর নাম ফেনী। কেউবা বলেন, মৌর্যে শাসনামলে চীনা পর্যটক ফাহিয়েন ভারত সফরের এক পর্যা য়ে একদিন অবস্থান করেন এই নদীর তীরে। পরে ফাহিয়েনের নাম থেকে ফেনী নামটি হয়। তবে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় হওয়ায় সাগরের ফেনা থেকে ফেনী নামটি এসে থাকতে পারে বলেও মনে করেন অনেকে। যদিও ফেনী জেলার পাশে হওয়ায় স্থানের নাম থেকে নদীর নামকরণ হওয়ার ব্যাখ্যাটিই অধিক যুক্তিযুক্ত।
এ নদীর তীরেই রামগড় থানা। ১৭৭৫ সালে ৬ পাউন্ড গোলার চারটি কামান ও দু’টি অনিয়মিত অশ্বারোহী দল নিয়ে গঠিত রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়নের সৌধও নদী তীর থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে। সৌধের দেওয়ালে রামগড় ব্যাটালিয়ন কি করে বিডিআর বাহিনীতে পরিণত হয় তার সংক্ষিপ্ত সারও লিখে রাখা আছে।
বিডিআর সৌধের কাছেই নয়নাভিরাম জলাশয় রামগড় লেক। তারওপর দৃষ্টিনন্দন এক ঝুলন্ত সেতু।
লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিজয় ভাস্কর্য জানিয়ে দিচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো রামগড়।
মুক্তিফৌজের সর্বপ্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এ রামগড়েই খোলা হয়। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাঙ্গামাটির পতন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর সরিয়ে এই রামগড়েই আনা হয়। মহালছড়িতে ২৭ এপ্রিল সম্মুখসমরে শহীদ হন ক্যাপটেন আফতাবুল কাদের বীর উত্তম। জালিয়াপাড়া হয়ে শহরে ঢোকার মুখেই তার সমাধি, স্মৃতিসৌধ। মূল সড়কের এক অংশের নামকরণও করা হয়েছে তার নামে। এছাড়া চা বাগান আর মান রাজবংশের আমলে নির্মিত একটি বৌদ্ধ বিহারও আছে রামগড়ে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, রামচন্দ্র নারায়ণ নামে জনৈক ব্যক্তি একটি গড় নির্মাণ করেন এখানে। সে থেকে এ এলাকার নাম হয় রামগড়। তবে অপর এক জনশ্রুতিতে বলা হচ্ছে, রামসাধু নামে এক সন্ন্যাসী ছিলেন এ এলাকায়। তার তপস্যার জন্য একটি ঘর বা গড় ছিলো। পরে রাম নামের সঙ্গে গড় শব্দটি জুড়ে নাম হয়ে যায় রামগড়। চট্টগ্রাম থেকে এখানকার দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার প্রায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জালিয়াপাড়া থেকে এখানে আসার ১৯ কিলোমিটার রাস্তার বাঁকে বাঁকে যেনো সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের চেয়ে এই রাস্তার উচ্চতাও অনেক বেশি।
** বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৬
জেডএম/