মাটিরাঙা (খাগড়াছড়ি) ঘুরে: এই গাছের নিচে বসে শীতল বাতাস লাগালে নাকি আয়ু বাড়ে মানুষের। অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাসীরা তাই এখানে এলে কিছুক্ষণ বসে যান শতবর্ষী বটের বয়সী শেকড়ে।
আয়ু বাড়ুক আর না বাড়ুক, এখানে এলে শরীর যে জুড়োবে তাতে কেনো সন্দেহ নেই। এখানকার আর সব পাহাড়ের ভেতর ডিমের মতো ফুলে আছে এই পাহাড়টা। কোথাও বাধা না পাওয়া পাহাড়ি বাতাস তাই হু হু গান শোনায় কানের কাছে। এ মুহূর্তে দক্ষিণ থেকে বইছে শরত শেষের বাতাস।
একর পাঁচেক জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বিশাল বট গাছটার জন্ম কখন কেউ জানে না। তবে বহু বছর ধরেই শতবর্ষী বট নামেই পরিচিতি এর। আরো ৫০ বছর পরও হয়তো এ গাছের নাম শতবর্ষীই থাকবে।
বছরের পর বছর ধরে নেমে আসা ঝুড়িমূলগুলো মাটির ভেতরে মুখ লুকিয়ে যেনো নিজেরাই বটবৃক্ষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে। এখানে তাই একের ভেতরে অনেক বটগাছ। কোনো কোনোখানে তো দুই ঝুড়িমূল গলাগলি করে রীতিমতো গাছের তোরণই গড়ে দিয়েছে। যেনো অভ্যাগতদের সম্মানে সাজিয়ে রেখেছে নিজেদের।
প্রকাণ্ড সাইজের কাণ্ডটাও পেঁচিয়ে রেখেছে অসংখ্য ঝুড়িমূল। আর কাণ্ড থেকে ছড়িয়ে থাকা ঘন শাখা-প্রশাখার নিচে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার। ভর সন্ধ্যায় সেই অন্ধকারে মায়াবি আলোর পরশ ছড়িয়ে আকাশে হাসছে ভরা চাঁদ। প্রবারণা পূর্ণিমার আরও দু’দিন বাকি থাকলেও চাঁদটা যেনো পূর্ণিমারই রূপ নিয়েছে। শতবর্ষী বটের ঝাঁকড়া মাথার ওপরে ঝুলে আছে তো আছেই।
উপরে চাঁদের আলো আর নিচে শীতল অন্ধকারে শরীর-মনে অবর্ণনীয় এক অনুভূতি। দিনের আলোয় এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে হয়তো। সারি সারি পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে দিগন্তে হারিয়ে যায় দৃষ্টি। কিন্তু সাঁঝের অন্ধকারে কতো দূরইবা আর দৃষ্টি চলে। চারিপাশের পাহাড়ের মাথাগুলোকে এখান থেকে জমাট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
খেদাছড়ির কাছে এই পাহাড়ের মাথাটায় মালভূমির আদলে এক ফালি সবুজ সমভূমি শুয়ে আছে শতবর্ষী বটের পা ছুঁয়ে। এই বটগাছের নামেই এ জায়গাটার নাম বতটলী। সবুজ মাঠের পাশে পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা বাজারটার নামও বটতলী বাজার। সন্ধ্যা পেরিয়েছে বলে অনেকটাই ক্রেতাশুন্য। দিন শেষের হিসাব গুনছে দোকানিরা। স্থানীয় আড্ডাবাজদের জন্য খুলে রাখা দোকানে ছোট ছোট সুস্বাদু পাহাড়ি কলা বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি দেড় টাকা দরে।
দিনের কাজ শেষে এমনই একটি দোকানে চা খেতে এসেছেন জাফর আহমেদ। সুযোগ পেয়ে গল্পের ঝাঁপি মেলতে শুরু করলেন তিনি। বললেন, আগে হাতি এসে এই গাছটায় শুড় বুলিয়ে সালাম করে যেতো বলে শুনেছি। এখন এখানে মানুষ বেড়ে যাওয়ায় আর হাতি আসে না। তবে আশপাশের পাহাড় আর উপত্যকায় কদাচিৎ এখনো হাতির দেখা মেলে।
প্রকৃতির কোলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই পাহাড়টার অবস্থান মাটিরাঙ্গা উপজেলায়। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের পশ্চিম দিকে। মাটিরাঙা বাজার থেকে গাজীনগরের দিকে যে রাস্তাটা গেছে সেটা ধরে ৫ কি ছয় কিলোমিটার এগুলে বাজার পার হয়ে এই বটতলী। চট্টগ্রাম থেকে এখানকার দূরত্ব ৮০ কিলোমিটারের মতো। আর খাগড়াছড়ি সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি রুটের যে কোনো বাসে মাটিরাঙা বাজারে নেমে অটো রিকশায় এখানে আসা যায়। গাজীনগর পর্যন্ত পাহাড়ি পথের সব বৈশিষ্ট্যই ছড়িয়ে আছে এখানে। প্রতিটি চড়াইয়ের বাঁকে বাঁকে মিশে আছে অবারিত প্রকৃতির নজরকাড়া রূপ।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, একবার প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড়ের উপরিভাগ ধুয়ে লাল বা রাঙা মাটি বেরিয়ে পড়ে বলেই এ এলাকার নাম মাটিরাঙা। এই মাটিরাঙার সৌন্দর্য শতবর্ষী বটের ছায়ায় যে কতোগুণ বেড়ে যায় তার হিসাব পাওয়া মুশকিলই বটে।
**বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
**বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৬
জেডএম/