ধুমনীঘাট (মহালছড়ি ঘুরে): পাহাড় ধসে রাস্তাটা বন্ধ। বেবিট্যাক্সি চালক কিছুতেই থিকথিকে আঠালো কাদার ওই পাহাড় পার হতে রাজি নন।
এবার দে ধাক্কা। চারজনে মিলে ধাক্কিয়ে কাদার ঢিবি পার করে ফের শুরু হলো পাহাড় বাওয়া। হাতের বাঁয়ে রাস্তার ওপর ঝুঁকে আসা খাড়া পাহাড়টায় ঝুলে থাকা রক্তজবার ঝোপ মাথা দুলিয়ে শুভকামনা জানালো যেনো। হাতের ডানের গভীর গিরিখাতে টান টান দাঁড়িয়ে থাকা গামারি গাছগুলোও যেনো বললো, ভয় নেই।
সাহসে ভর করে এবার বেবিট্যাক্সি উঠছে তো উঠছেই। একটু পরপরই রাস্তায় হাঁ করে তাকিয়ে থাকা গর্তগুলোর শাসানি মনেই বসতে দিলো না পাহাড়ের ঢালে জুম কাটার দৃশ্য।
সাতশ’ ফুটেরও বেশী উঁচু মেটে হেলিপ্যাডটায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে সুর্যটাও বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। একপাশে দাঁড়িয়ে পাহাড়ি বাতাসে মাথা দোলাতে থাকা বটগাছটাকে একনজর দেখে শুরু হলো পাহাড় বেয়ে নিচে নামা।
এদিকটায় বাঙালি বসতি একদমই নেই। হাতের বাঁয়ে চাকমা পাড়াটার পর আর কোনো বসতিও নেই সামনে। চারিদিকে ঘন বন। তার ভেতর দিয়ে প্রায় ৭০ ডিগ্রি ঢালু হয়ে নিচে নামা খাড়া ট্রেইলটা বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে।
জান বাজি রেখে এক ধাপ দু’ধাপ করে নিচে নামতেই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। ঘনঝোপের ভেতর দিয়ে কুল কুল করে নেমে আসছে পানি। গোড়ালি অবধি পানিতে ডুবিয়ে একটু সময় শীতল পানির আদর নিতেই ক্লান্তি উবে গেলো শরীর থেকে।
ছড়া থেকে ওঠার পর এক চিলতে ট্রেইলটায় আরো চেপে এলো ঘন ঝোপ। ঢাল বেয়ে নামার সময় নাম না জানা পাহাড়ি লতা ঠিক যেনো শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে।
জনবসতি তো দূরের কথা, এই গহীন বনে কোনো জনমনিষ্যিরও চিহ্ন নেই। সারাক্ষণই ভয়ের সঙ্গে একটা লড়াই চলছে ভেতর ভেতর।
ঠিক এমন সময় গাছগাছালির প্রাচীর ভেদ করে কানে এলো জলপ্রপাতের গর্জন। এই গর্জনটাই আরো বাড়িয়ে দিলো প্রাণশক্তি। সব ভয় উবে গেলো নিমিষে। বেড়ে গেলো নিচে নামার গতি।
ঘাসবন আর পাহাড়ি আগাছার ঝোপটা পেরুতেই এবার বিস্ময়ে হতবাক। দু’তিন ধাপের জলপ্রপাত তৈরি করে বইছে আনিন্দ্য সুন্দর এক পাহাড়ি ছড়া। মাটির পাহাড়টাকে রক্ষা করছে সুবিন্যস্ত করে সাজানো কিছু পাথর। কোনোটা বহুভূজ আকৃতির, তো কোনোটা আবার বিশাল চাতকির রূপ নিয়েছে। পাথর চাঁইয়ের মাঝখানে একাধিক ছোট ছোট চৌবাচ্চাও তৈরি হয়েছে যেনো।
এই গহীন অরণ্যে এমন করে কে সাজালো এসব পাথর! কি করে এতো সুন্দর করে নিজেকে সাজায় প্রকৃতি?
যদিও জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রকৃতি নয়, রামায়নের তিন বিখ্যাত চরিত্র রাম-সীতা আর লক্ষ্মণেরই কাজ এগুলো। ত্রাবর যুগের রাজাধিরাজ দশরথের আদেশে তার দুই পুত্র আর পুত্রবধূ বনবাসে গেলে কোনো এক সময় এ স্থানও পরিভ্রমণ করেন তারা। তখন কিছু দিন এখানে অবস্থানও করেন রাম-সীতা আর লক্ষ্মণ। সে সময় সীতাই পাথরগুলো সুবিন্যস্ত করেন নিজের মতো করে। গোড়ালি সমান স্রোতে গোসলের জন্য পাথরের চাঙর সাজিয়ে তৈরি করেন প্রাকৃতিক চৌবাচ্চা। সেই থেকে এই স্থান ধুমনিঘাট তীর্থ নামেই পরিচিত।
জায়গাটা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহালছড়ি উপজেলার ১ নম্বর সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে এখানকার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারের মতো।
মহালছড়ি পার হওয়ার পর রাঙামাটিমুখী রাস্তাটা যেখানে ওয়াই শেপ নিয়েছে সেখানটায় ডানের সিঙ্গেল রোডটা ধরলে ধুমনীঘাট পাহাড়ে পৌঁছুতে ৫ কি ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। পাহাড়ি ফল কেনার জন্য ব্যাপারিদের একটা আড়তও আছে সেখানে। চাইলে সস্তায় কিনে খেতে পারেন টাটকা পেপে। সঙ্গে পাহাড়ি এক বৃদ্ধার একমাত্র টঙ দোকানটায় মিলবে চা-কলা।
**বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
**বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৬
জেডএম/