ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভোটের-কথা

পরিবারতন্ত্রেই অটল নাটোর বিএনপির ‘একনায়ক’ দুলু

রাইসুল ইসলাম, এডিশনাল আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৯ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৭
পরিবারতন্ত্রেই অটল নাটোর বিএনপির ‘একনায়ক’ দুলু সাদা রঙের তিনতলা বাড়ি। ইনসেটে, বাড়ির মালিক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু

নাটোর থেকে: নাটোর শহরের আলাইপুর এলাকা। প্রধান সড়কের পাশেই একটি সাদা রঙের তিনতলা বাড়ি। বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা এটি তালাবদ্ধ। জানা গেল, বেশিরভাগ সময়ই তালাবদ্ধ থাকে বাড়িটি।

 

বাড়িটির মালিক সাবেক বিএনপি-জামায়াত সরকারের উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। এখন নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি।

অবশ্য সারাদেশেই বিএনপির রাজনীতির এক আলোচিত চরিত্র।

নাটোর বিএনপির একচ্ছত্র অধিপতি দুলু। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় নাটোরে বিএনপির রাজনীতি। অনুসারীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়, বিরোধীদের চোখে ঘৃণিত তিনি।

তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে নাটোর বিএনপিতে তিনি কায়েম করে আছেন একচ্ছত্র আধিপত্য। একে একে তার বিরোধী প্রায় সব বিএনপিনেতাকেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, জেলার বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময় মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রেও তিনি বেছে নেন নিজের আত্মীয়স্বজনকেই। দলে তার বিরুদ্ধে মুখ খুললে হতে হয় অপমানিত, অপদস্থ এবং সবশেষে বহিষ্কৃত।

১৩ বছর ধরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শহীদুল ইসলাম বাচ্চু। একই কমিটির সভাপতি ছিলেন দুলুও। কিন্তু মতবিরোধের কারণে শহীদুল ইসলাম বাচ্চুকেও বহিষ্কার করা হয়। এখানেই শেষ নয়। একাধিকবার হামলাও চালানো হয় শহরের ফৌজদারি পাড়ায় অবস্থিত বাচ্চুর বাড়িতে। এমনকি বাড়ির উঠানে ঢেলে রাখা হয় মানুষের মল।

দুলু-বিরোধীদের অভিযোগ, দুলুর প্রশ্রয়েই এসব অপকর্ম করেছে তার অনুগত ক্যাডার বাহিনি।

দুলুর বিরুদ্ধে বিরোধীদের রয়েছে ব্যাপক স্বজনপ্রীতির অভিযোগ।

বিরোধীদের অভিযোগ, নাটোর বিএনপিতে কোনো গণতন্ত্র নেই, আছে কেবল ‘দুলুতন্ত্র’। দুলুর কথাই এখানে শেষ কথা। তৃণমূল নেতাকর্মীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দামই নেই এখানে।

জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদসহ ছাত্রদল ও যুবদলসহ জেলা-বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সব পর্যায়েই তিনি বসিয়েছেন নিজের আত্মীয় স্বজনদের। এমনকি সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও নিজের আত্মীয় স্বজন ও একান্ত অনুগতদের হাতে ধানের শীষের টিকিট তুলে দিয়েছেন তিনি।

দুলু নিজে জেলা বিএনপির সভাপতি, স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীন সহ-সভাপতি, বড় ভাই রুহুল আমিন তালুকদার টগর পৌর বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক, চাচাতো ভাই আতিকুর রহমান তালুকদার নলডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি, আরেক চাচাতো ভাই আবিদুর রহমান তালুকদার বিপ্রবেলঘরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি, আবদুল হাই তালুকদার জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক, খালাতো ভাই মাতিনুর রহমান মৃধা মাধনগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। জেলা যুবদলের সভাপতি তার আপন ভাতিজা আব্দুল হাই তালুকদার ডালিম। আপন ভাগনে হেলাল জেলা জাসাসের সভাপতি।

গত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির হেরে যাওয়া প্রার্থী রহিম নেওয়াজ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি। তিনি হলেন রুহুল কুদ্দুসের বড় ভাই আমিন তালুকদারের মেয়ে রেবা তালুকদারের স্বামী।

এ রকম তার প্রায় ১৭ জন আত্মীয়স্বজনকে জেলার বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদে তিনি বসিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিরোধীরা জানালেন, দলে দুলুর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই তার উপর নেমে আসে বহিষ্কারের খাঁড়া। বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাচ্চু। তিনি টানা ১৩ বছর নাটোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জেলা বিএনপির আরেক সহ-সভাপতি আবদুল মান্নাফও ২০১২ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হন।

এছাড়া বিভিন্ন সময় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুল হক ডিউক, জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও গোপালপুর পৌরসভার চারবারের মেয়র মঞ্জুরুল ইসলাম বিমল, বাগাতিপাড়া উপজেলা বিএনপি সভাপতি গোলাম মোস্তফা নয়ন, বড়াইগ্রাম উপজেলা বিএনপি সভাপতি একরামুল আলম, গুরুদাসপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র মশিউর রহমান বাবলু, বাগাতিপাড়া পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক একেএম শরীফুল ইসলাম লেনিন, সিংড়া পৌর বিএনপির সহসভাপতি বজলার রহমান বাচ্চু, লালপুর থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুর রহমান সরকার, জেলা ছাত্রদল সভাপতি ফেরদৌস আলম মুক্তা। এমনকি বহিষ্কার করা হয় জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সিরাজুল ইসলামকেও।

বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের দাবি, দুলু আত্মীয়স্বজনদের দলের বিভিন্ন পদে বসিয়েই ক্ষান্ত হননি, দল ক্ষমতায় থাকার সময় জেলার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ কমিটিসহ জেলার বিভিন্ন স্কুল কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি এবং অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকের পদেও নিজের আত্মীয়স্বজনকে বসিয়েছেন। এমনকি তার ভাই টগর বিএনপির আমলে একসঙ্গে ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্ব আঁকড়ে ছিলেন।

নাটোর শহরে যোগাযোগ করলাম দুলু বিরোধী বহিষ্কৃত নেতাদের সঙ্গে। দুলুর ভয়ে এখনও আতঙ্কিত তারা। নাম না প্রকাশের শর্তে তারা বলেন,   বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল নাটোর। এখানে রয়েছে ধানের শীষের বিপুল জনপ্রিয়তা। কিন্তু দুলু বিএনপির এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে নিজের এবং পরিবারের আখেরই কেবল গুছিয়েছিলেন।

তারা আরও দাবি করেন, নাটোরে বিএনপির জনপ্রিয়তাকেই জিম্মি করেছেন দুলু। নাটোরে তার এবং তার আত্মীয়স্বজন ও ক্যাডার বাহিনির অপকর্মের কারণে শহরে মুখ দেখাতে পারেন না জেলা-বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা। এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার কারণেই দল থেকে একে একে বহিষ্কার করা হয় তাদের।

তবে দুলুর সমর্থক বলে পরিচিত জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিরোধীদের এসব কথাবার্তার কোনো ভিত্তি নেই। সাগর থেকে এক বালতি পানি তুলে নিলে সাগর শুকিয়ে যায় না। নাটোরের রাজনীতিতে দুলুর কোনো বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হবেন তিনি। কোনো কারণে তিনি না পারলে প্রার্থী হবেন তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৭
আরআই/জেএম

** নাটোর সদরে নৌকা ডুবতে পারে গ্রুপিং-কোন্দলে!
** নাটোর সদরে নৌকা পেতে টক্কর সেয়ানে সেয়ানে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।