গ্রামগঞ্জে অনেক মানুষের অভিযোগ, ইসরাফিল আলম অল্পদিনেই টাকার কুমির হয়ে গিয়েছেন।
জিজ্ঞাসা করি, ‘কোথায় কোথায় টাকা খেয়েছেন?’ মানুষ উত্তর দেন, ‘তিনি কাশিমপুরের জমিদার বাড়ির জমি দখল করেছেন।
জিজ্ঞাসা করি, ‘আর কি কি করেছেন তিনি?’ হাটে-ঘাটে মানুষ জানান, তিনি নাকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন। এভাবেই রানীনগর সদর (খট্টেশ্বর) ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী বনে যান এক সময়কার জেএমবি সদস্য ও বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান পিন্টু। আর সেই পিন্টুর হাতেই কিনা নৌকার পতাকা ধরিয়ে দিয়েছেন ইসরাফিল! বঞ্চিত হয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসা গোলাম হোসেন।
কিছু উন্নয়নের চিত্রও চোখে পড়ে ইসরাফিল আলমের এলাকায়। নওগাঁ শহর থেকে রানীনগর এবং আত্রাই উপজেলায় যাওয়ার সড়ক পুরোটাই পাকা হয়েছে। এছাড়াও দুই উপজেলাতেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান এখানকার ব্যবসায়ী রুহুল আলম।
রুহুল আলম বলেন, এখানে শিক্ষা পরিস্থিতি ভাল ছিল না। দুটি নতুন কলেজ স্থাপন করেছেন ইসরাফিল আলম। এছাড়াও এলাকাতে তার উপস্থিতি ভাল। সময়-সুযোগ পেলেই এলাকায় আসেন।
এই সংসদীয় আসনটি আওয়ামী লীগের হাতে আছে গত ৯ বছর ধরে। ততদিন ধরেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন ইসরাফিল আলম। এর আগে ১৯৯০ সাল থেকে টানা ১৬ বছর বিএনপি’র পতাকাই উড়েছে এ তল্লাটে। জেএমবি’র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আঁতাত আর বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে বিএনপির তৎকালীন সংসদ সদস্য আলমগীর কবিরের দোস্তিয়ানার নীরব প্রতিবাদ হিসেবে ভোটারদের বড় একটা অংশ চলে আসেন আওয়ামী লীগের কোর্টে। তবে সেই কোর্টে এখন ইসরাফিল আলমের নেতৃত্ব টিকে থাকবে কিনা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এজন্য তার নিজের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকেই মূলত দায়ী করছেন এখানকার সাধারণ মানুষ।
এক সময় বিএনপির প্রাধান্যপুষ্ট এই এলাকায় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন ওয়াহিদুর রহমান। তবে ২০০৮ সাল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসরাফিল আলম হাল ধরেন নৌকার। অথচ তিনিই এখন জনবিচ্ছিন্ন। এর কারণ তার ভোগ-দখলের মানসিকতা।
রানীনগর রেল স্টেশনে কথা হয় স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বললেন, অনেক দিন ধরে সংসদ সদস্য থাকা ইসরাফিল আলম এখন ভোগ দখলে লিপ্ত। সবকিছু থেকেই অর্থের ভাগীদার হতে চান। মানুষ আর তাকে চাইছে না। মানুষ এখন নতুন মুখ দেখতে চাইছে।
এই লোকের মুখেই শোনা গেল, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ওহিদুর রহমানের ছেলে ও নওগাঁ জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক সুমন এই আসনে নৌকার টিকেট পেতে দৌড় শুরু করেছেন।
নওগাঁ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক সুমনের মুখেও শোনা গেল ইসরাফিলের জমি দখলের অভিযোগ।
ওমর ফারুক সুমনের অভিযোগ, সাংসদ ইসরাফিল আলম রানীনগর ও আত্রাইয়ে বিপুল পরিমাণ জমি দখল করেছেন। রক্তদহ বিলেই নাকি তিনি কয়েকশ বিঘা জমি দখল করেছেন। আর কাশিমপুর জমিদারবাড়ির জমি দখল করে মিনারেল ওয়াটার কারখানা প্রতিষ্ঠা করতেও নাকি চেয়েছিলেন।
ওমর ফারুক সুমন আরও বলেন, ইসরাফিল আলম আত্রাইয়ে ইসলামগাথি জমিদারবাড়ির জমি দখল করেছেন। যার একাংশ নিজের নামে এবং বাকিটা অনুসারীদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছেন। তবে ভারতে বসবাসকারী জমিদার বাড়ির এক শরিকদার আদালতের শরণাপন্ন হওয়ায় এখনো পুরোটা সম্পত্তি ভোগ করতে পারছেন না ইসরাফিল আলম।
ওমর ফারুকের অভিযোগ, সাংসদের দখল করা জমির মধ্যে আরো রয়েছে ভটকই মৌজায়, রাতোয়ালে, আটনা বাঁশবাড়িয়াতে, বেলঘরিয়াতে, গোণাপূর্বপাড়ে, সর্বরামপুরে, আবাদপুকুরে হিন্দুদের জমিসহ প্রচুর জমি। এছাড়া পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ির নিজস্ব জমিও চার ব্যক্তিকে দিয়ে দখল করিয়েছেন তিনি।
জমি দিতে (বিক্রি করতে) অনিচ্ছুক গৃহস্থ, আলাউদ্দিন মেম্বারের ছেলে এলাহীকে মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে ইসরাফিলের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের চাকুরির সুযোগ না দিয়ে অর্থের বিনিময়ে চাকুরি দেয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে ইসরাফিল আলমের বিরুদ্ধে।
রানীনগর ও আত্রাইয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের কথা বলে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তিনি। অথচ সবাইকে চাকুরি দিতে পারেননি। কনস্টেবল নিয়োগের কথা বলে ৪০ জনের কাছ থেকে টাকা নিলেও চাকুরি হয় ২ জনের। আত্রাই উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাইটগার্ড নিয়োগে তিনি অর্থ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।
এছাড়াও বিদ্যুতের মিটার প্রদান, বাজারে দোকান বিক্রি, টোল ফ্রি বাজারে চাঁদা উত্তোলনসহ নিয়োগবাণিজ্য, পোস্টার ও ফেস্টুন ছিঁড়ে এবং নেতাকর্মীদের মারধর করে প্রচারণায় ব্যঘাত করার অভিযোগ করেন ওমর ফারুক সুমন।
এলাকায় ক্যাবল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে ইসরাফিল আলমের বিরুদ্ধে। রানীনগরের ব্যবসায়ী মিথুন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ইসরাফিলের লোকজন গায়ের জোরে এলাকায় ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন। তিনি বাধা দিতে গেলে তারা মারধর করে। এসময় এমপি’র লোকেরা অস্ত্রও প্রদর্শন করেন।
‘মামলা দিয়েছিলেন?’-এ প্রশ্ন করা হয় অভিযোগকারী মিথুন চৌধুরীকে। জবাবে মিথুন চৌধুরী বলেন, ‘মামলা দিয়ে এমপি ও তার লোকদের সঙ্গে টক্কর দেয়া যাবে না বলে আর সেপথে আগাইনি। ’
এসব অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করেছেন ইসরাফিল আলম। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। ’
পতিসরে রবীন্দ্রনাথের জায়গা এমপি’র লোকজন দখল করেছেন বলে যে অভিযোগ, এ বিষয়ে ইসরাফিল আলম বলেন, ‘পতিসরেরটা ঠিক আছে। ওই জমি প্রত্নবিভাগ টেকওভার করেছে।
কাশিমপুরে জমিদারবাড়ির জমিদখলের যে কথাটি বলা হচ্ছে, এর পুরো জায়গাই ‘শত্রু সম্পত্তি’ (যদিও এখন বলা হয়, ‘অর্পিত সম্পত্তি’)। কিছু জায়গা ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেকর্ডভূক্ত। ৩০ শতাংশ। সত্যি বলতে দখলে ছিল। অধিকাংশ দখলদার বিএনপির লোকজন। কৃষিবিভাগ থেকে প্রতিবছর খাজনা কেটে চেক কেটে নিতো। নওগাঁর একজন ভদ্রলোক থাকতেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ করতেন। তার নামে ১২ বিঘা জমি ছিল চেক করা। তাকে দখলদাররা ধানও দিতো না। তাকে আসতেও দিত না। তিনি আমাকে ধরলেন। পরে তার থেকে মালিকানা ট্রান্সফার করি। সেখানে কৃষিখামার প্রজেক্ট করি। কৃষি প্রদর্শনী খামার। এক ছটাক জমিও দখল করা নেই। সব শত্রু সম্পত্তি, চেক কাটা। সরকার আগে কৃষি খাতে যে জমি বরাদ্দ দিতো এখন বাণিজ্যিক খাতেও তা দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘কিছু জমি আছে, আট বিঘা কি ১২ বিঘা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এর বাইরে জমিদার বাড়ি দখলের সুযোগ কারো নাই। পুরো জমিদার বাড়িটিই আছে সরকারি হেফাজতে। সরকার প্রতিবছর যতটুকু খাজনার বিনিময়ে লিজ দিতে পারে, ততটুকু কৃষি আবাদি জমি লিজ দেয়। যে কাঠামোটুকু পড়ে আছে, সেটুকু লিজ দিতে পারে না। ’
তিনি বলেন, ‘সেখানে রেজিস্ট্রি অফিস আছে, পোস্ট অফিস আছে। সেখানে কিছু গরিব লোকও বাড়ি করেছে। তাদের তো আর ওঠানো যায় না। একটি মন্দির পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে সেখানে কিছু বাড়ি সরিয়ে দিতে হয়েছে। তাদের পুর্নবাসনও করা হয়েছে। কিছু বাড়ি করা যায়নি। মন্দিরের কাঠামো ঠিক করার জন্যে। ’
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ ধরনের অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে করছেন দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ডকুমেন্টও রয়েছে। ডিসি অফিস থেকে আমাকে ডিও করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্যে অনুমোদন দিয়েছে। ওরা একদম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করেছে। ভূমি অফিসে প্রতি বছরে নবায়ন করাতে হয়, নকশাসহ। ’
সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগবাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কখনো স্বচ্ছ করা যায় না। সেখানে দুই জন সরকারি প্রতিনিধি থাকেন। সরকারি হাইস্কুলে তো আমরা থাকি না। এসব ক্ষেত্রে অনেকেই এমপির নাম ভাঙ্গায়। এখানে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০২৪ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৭
এমএন/জেএম
** ইউপি মেম্বার থেকে সর্বজয়ী এমপি