ঢাকা, শনিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

কার ওপর এই করের বোঝা

মোফাজ্জল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
কার ওপর এই করের বোঝা সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম

পৃথিবীতে কেউ অজাতশত্রু নয়। এমনকি সংসারবিবাগি পীর-ফকির-দরবেশ-সন্ন্যাসী, যাদের পায়ে তাদের ভক্তকুল অহর্নিশ লুটোপুটি খায়, তারাও বলতে পারবেন না তাঁরা শত্রুমুক্ত।

আর কেউ না হোক, ওই আধ্যাত্মিক পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী কীভাবে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বিনষ্ট করা যায় সেই চেষ্টায় ফন্দিফিকির আঁটতে থাকেন। এমনকি কখনো কখনো হিংসাত্মক কার্যকলাপেরও আশ্রয় গ্রহণ করেন।

আর সাধারণ মানুষকে তো তার অস্তিত্বের জন্য উঠতে-বসতে সারাক্ষণ শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়।

কথাটি বলছি এ জন্য যে বর্তমানে বাংলাদেশ নামক দেশটির শাসনভার যারা গ্রহণ করেছেন, পাঁচ-ছয় মাস ধরে যারা এই দেশের মানুষের ‘ভাগ্যবিধাতা’, তারাও মানুষ, তাঁদেরও অগণিত শুভার্থী যেমন আছে সারা দেশে, তেমনি আছে ‘মুখে বেজায় মিঠে, নিমনিশিন্দে পেটে’ মার্কা গোপন শত্রুর দল। এরা বেশির ভাগই পূর্ববতী সরকারের আমলের সুবিধাভোগীর দল, যারা স্বর্গ থেকে তাদের অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক পতন কিছুতেই মেনে নিতে পারার কথা নয়। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে এরা নিয়মিত মালাই-মাখন সেবা করে এখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য (আপাতত) গোপনে নানা কূটকৌশল ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নেবে।

এসব ‘সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়’ লোকজন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে কর্তৃপক্ষকে আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ও জনসহায়ক শলাপরামর্শ দেবে। বিশেষ করে দেশের বিশৃঙ্খল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (যা বিগত সরকারের কিছু দুর্নীতিবাজ, তৈলবাজ বাহিনী প্রধানের কারণে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত এবং সময়োচিত দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে যা এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়) এবং অর্থনীতির ব্যাপারে উল্টাপাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনদুর্ভোগ লাঘব হওয়ার পরিবর্তে আরো শোচনীয় আকার ধারণ করার আশঙ্কা আছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিশ্চয়ই উন্নতি হয়েছে এ কথা আমরা আগেই বলেছি। তবে এখনো বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘাত-সংঘর্ষ, অহেতুক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট ইত্যাদির ক্ষেত্রে খুব একটা উন্নতি হয়েছে বললে সত্যের অপলাপ হবে।

এগুলোর দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি হয়তো এই স্বল্পমেয়াদি সরকারের সময়ে সম্ভব নয়। উন্নয়নের গতিপথ নির্ধারণ হয়তো এই সরকার করে যেতে পারে, যার সুফল আসবে নিশ্চয়ই, তবে তা হবে সময়সাপেক্ষ।

কার ওপর এই করের বোঝা আজকে আমাদের আলোচনা যে বিষয়ে, তা কিন্তু ধীরে চলার কোনো বিষয় নয়। আর তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য। বাংলায় ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’ বলে যে প্রবচনটি আছে, তা কিন্তু একটি পরীক্ষিত সত্য।

পেট ঠান্ডা তো মেজাজ শরিফও ভালো। আর পেটে দানাপানি কিছু না পড়লে মেজাজ-মর্জি সহজেই খিঁচড়ে যায়। তখন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে যতই মিষ্টিমধুর বচন শোনানো হোক না কেন, তা তার কাছে বিস্বাদ মনে হয়।

৫ আগস্ট ২০২৪ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় রকমের মাইলফলক। কোনো বিশেষণ ব্যবহার না করে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ওই দিনটি ছিল বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য নাজাত বা মুক্তি দিবস। যে সিন্দাবাদের ভূতটি দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল, তা সেদিন যাকে বলে একবস্ত্রে পালিয়ে যায়। দিনটি ছিল বাঙালির রাহুমুক্তির দিন। তারা দেশকে নিয়ে, দেশের নেতৃত্বকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বিশেষ করে ওই মাহেন্দ্রক্ষণে যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গুণী মানুষটি দেশের হাল ধরেন, তার ওপর আস্থা না রাখার কোনো কারণ ছিল না। সেদিন সারা জাতি ওই মহান ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়েছিল নতুন আশায় বুক বেঁধে, চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। এমন স্বপ্ন দেখা অন্যায্য কিছু নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত আছে দুঃস্বপ্নের কালরাত্রির অবসানে নতুন সূর্যোদয়ের এবং সেই সূর্যকে অভিবাদন জানানোর।

এখন কথা হচ্ছে সূর্যকরোজ্জ্বল সকালটাকে তো সবাই মিলে স্বাগত জানাল ঠিকই, কিন্তু বাকি সারাটা দিন কেমন কাটবে। পূর্ব দিগন্তের ওই রক্তলাল সূর্যটাকে কি রাহু গ্রাস করে ফেলবে? হঠাৎ করে কি ঈশানকোণে মেঘ জমে প্রলয়-ঝঞ্ঝা শুরু হয়ে যাবে? পাঠক হয়তো জানতে চাইবেন আমরা কেন শঙ্কিত বোধ করছি। দেখুন, একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিষধর গোখরা সাপকে পিটিয়ে ভর্তা করে ফেললেও তার লেজের নড়াচড়া খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় না। হয়তো সেই নড়াচড়াসর্বস্ব লেজ আখেরে কিছুই করতে পারবে না, তবু সাবধানের মার নেই। বিশেষ করে যেখানে গোখরাকে বধ করা হয়নি, সে জান নিয়ে পালিয়ে গিয়ে তার জানি দোস্তের উষ্ণ আশ্রয়ে দিব্যি দুধ-কলা সেবা করছে নিয়মিত।

এ তো গেল এক দিক। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে দেশবাসী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও স্বাগত জানিয়ে ৮ আগস্ট বরণ করেছে, তারা যখন দেখবে তার নিজের এবং পরিবারের অন্য সবার, বিশেষ করে কচিকাঁচাদের পাতে খাবারের টান পড়েছে, তখন কিন্তু কে স্বৈরাচার আর কে আমের আচার, তা গৌণ হয়ে গিয়ে শুরু হবে কে চাল-ডাল-তেল-নুন শাক-সবজির ভালো জোগানদার আর কে নয়, সেই হিসাব-কিতাব। আমরা জানি, এই চরম বৈষম্যময় দেশে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী চালের কেজি পাঁচ টাকা বাড়লেই প্রমাদ গোনে। আবার কেউ কেউ ৫০ টাকার চাল ৫০০ টাকা হলেও গা করবে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দ্রব্যমূল্যের, বিশেষ করে খাদ্যবস্তুর ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। সরকারের ‘ব্যাড লাক খারাপ’, তারাও ক্ষমতায় এলো, দেশেও কোনো কোনো জেলায় দেখা দিল প্রবল বন্যা। গোদের ওপর বিষফোড়া আর কাকে বলে! নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম হু হু করে বাড়তে লাগল। আর সেই যে বাড়ল তার আর কমার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

সংগত কারণেই বর্তমান সরকারকে আমরা দ্রব্যমূল্য আর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শুরু থেকেই বলে এসেছি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পরিস্থিতি মোটামুটি সামাল দিতে পেরেছে বলা যায়। অবশ্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব যেসব সংস্থার, তারা গত কয়েক মাসে তেমন কোনো তৎপরতা দেখাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। চালের দাম সেই যে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, তা নামার আর নাম নেই। একই অবস্থা মাছ-মাংস, তেল-মসলার বেলায়ও। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে সবখানে প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করলেও ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের বাজার, যেখানে জিনিসপত্রের দাম একবার কারণে-অকারণে ঊর্ধ্বমুখী হলে তা আর নিম্নগামী হয় না। হলেও তা ব্যতিক্রম। যেমন—সপ্তাহখানেক ধরে ডিম ও পেঁয়াজের দাম কিছুটা হলেও কমেছে। আর পৌষের শীত জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে শীতকালীন শাক-সবজির সরবরাহ বেড়েছে। সেই সঙ্গে কিছুটা হলেও সহনীয় হয়ে উঠেছে সেগুলোর দাম। আলহামদুলিল্লাহ।

কিন্তু বলে না, এত সুখ কি আমাদের কপালে সইবে? পাছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দেশবাসীর আস্থার পারদ স্থিতিশীল হয়ে ওঠে, সে জন্য ‘পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে’ (মাইকেল মধুসূদন দত্ত : মেঘনাদবধ কাব্য)। নল রাজার শরীরে কলি কী করে ঢুকে পড়ে মনে আছে? রাজামশায় জলবিয়োগের পর কয়েক মুহূর্ত অশৌচ ছিলেন। আর দুষ্ট কলি সেই ফাঁকে সুড়ুৎ করে প্রবেশ করে তাঁর পূতপবিত্র নধরকান্তি দেহকে অপবিত্র করে ফেলে। তা হঠাৎ করে এই উপমা মনে পড়ল কেন? বলছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ফ্রম ডে ওয়ান যারা তক্কেতক্কে আছে, তারা দেখল দ্রব্যমূল্য যদি কমতে থাকে, তাহলে হায় হায়, প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর সরকারের জনপ্রিয়তা তরতর করে বাড়তে থাকবে। অতএব? অতএব দ্রব্যমূল্য কমতে দেওয়া চলবে না, বাড়াতে হবে। এবং তা খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র থেকে শুরু করে কেনাবেচার জগতের তাবৎ সামগ্রীর। তাহলে কী করতে হবে? সহজ উপায় হচ্ছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দাও। সরকারকে বোঝাতে হবে, আপনার বাজেটের যে বিশাল ঘাটতি, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আর তা না করতে পারলে আপনার পথচলা কঠিন হয়ে পড়বে।

তাই আমাদের সুচিন্তিত পরামর্শ হচ্ছে, ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স (ভ্যাট) এবং সাপ্লিমেন্টারি ট্যাক্স বসিয়ে পাবলিকের পকেট কেটে ঘাটতি পূরণ করে নিন। বুঝলাম। সহজ হিসাব। পাবলিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সরকারি ব্যয় নির্বাহ করবেন। এককথায় কই মাছের তেল দিয়ে কই মাছ ভাজবেন। কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন কেন, বেচারা কই মাছের এখন দেওয়ার মতো তেল নেই। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তের মানুষ, দুবেলা দু-মুঠো খাবার জোটাতে চোখে অন্ধকার দেখছে। এর মধ্যে সরকার যদি কোনো অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে হঠাৎই দুম করে ভোগ্য পণ্য এবং বিভিন্ন সেবামূলক বৃত্তির ওপর নতুন করে ট্যাক্স বসায়, তাহলে কেমন লাগে বলুন। দেশবাসী তো এই সরকারকে জনবান্ধব সরকার বলেই জানে। তারা যদি এখন পাঁচ মাসের মাথায় বলে, এই বুঝি বন্ধুত্বের নমুনা, তাহলে?

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যারা মূল কারিগর, তারা কিন্তু আগের আমলে যেমন, এখনো তেমনি দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে। আগে অর্থাৎ এই দুই দশক আগেও লোকে তাদের মজুদদার, কালোবাজারি—এসব নামে ডাকত। এখন তাদের পদবি হয়েছে সিন্ডিকেট। তাদের নিয়ে সব আমলেই তর্জনগর্জন, হৈচৈ হয় ভালোই, কিন্তু কোন জাদুমন্ত্রবলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় সব সময়। এখনো তারা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে দ্রব্যমূল্যের নাটাই ঘোরাচ্ছে। তেমনি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা। এটা কি আসলে কাজ করে, নাকি মাঝে মাঝে আবির্ভূত হয়ে জানান দেয়, সাধু সাবধান। আমরা আশপাশেই আছি কিন্তু।

তাদের হুংকারে বেচারা সাধু ঠিকই সাবধান হয়ে বাজার-সদাই বাদ দিয়ে ঘরে বসে ঝিমায়, আর অসাধু ব্যবসায়ীরা লুটপাট চালিয়ে যায় ইচ্ছামতো। সদাশয় সরকারের প্রতি বিনীত আরজ, পাষণ্ড দুর্নীতিবাজদের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য দেখানোর কোনো দরকার নেই, মোটেই প্রয়োজন নেই ‘এই সরকার বড় ভালো মানুষের সরকার, তারা ফ্যাসিস্টদের মতো গুলি করে মানুষ মারে না’—এই সার্টিফিকেট চোর-চোট্টা-বদমাশদের কাছ থেকে পাওয়ার। দেশের গরিবগুরবা সৎ মানুষই হোক আপনাদের শক্তির উৎস—এই কামনা করি।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।