ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০ শাবান ১৪৪৬

অন্যান্য

আবাসন খাতে স্থবিরতা, নেই নতুন প্রকল্পের কাজ

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৫
আবাসন খাতে স্থবিরতা, নেই নতুন প্রকল্পের কাজ

দেশের আবাসন খাতে স্থবিরতা চলছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে রাজধানীতে ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি এক বছরের ব্যবধানে ২০ শতাংশ কমেছে।

বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা আর্থিক সংকটে পড়েছে। পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা বলছেন, মূলত রড ও সিমেন্টের মতো কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এতে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে গেছে। একই সঙ্গে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও স্থবিরতা চলছে। ফলে নির্মাণকাজের প্রধান দুই উপকরণ রড ও সিমেন্টের বিক্রিতে ধস নেমেছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় পাঁচ মাস ধরে ফ্ল্যাটের বিক্রি কম থাকায় অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন ও অফিসের ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও কম দামে দু-একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেউ কেউ। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে আবাসন খাতের ব্যবসার উন্নতি হবে। টাকার প্রবাহ বাড়লে ফ্ল্যাটের বিক্রিও বাড়বে বলে উদ্যোক্তাদের আশা।

জানা গেছে, দেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ সব সময় আবাসনে বিনিয়োগ করে থাকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আত্মগোপনে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবাসনে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ। ফলে বিশেষ ওই গোষ্ঠীর বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা ‘ড্যাপ’ নামে পরিচিত। ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে এটি কার্যকর করা হয়। কিন্তু শুরু থেকে ড্যাপ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন ড্যাপ বৈষম্যমূলক।  

বর্তমানে আবাসনশিল্পে যে সংকট চলছে তাতে প্রধান সমস্যা এই ড্যাপ। এটি আবাসন খাতের জন্য মারণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা ড্যাপ সংশোধনের দাবি জানিয়ে বলেন, এটি সংশোধন না করা হলে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে দেশের কর্মসংস্থানে অবদান রাখা আবাসন খাত।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে ফ্ল্যাট বিক্রি কিছুটা কমে গেছে। আগে যারা বড় আকারের ফ্ল্যাট কিনত, তারা এখন নেই। বরং তারা এখন নিজেদের সম্পদ বিক্রিতে নেমেছে। ’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই নতুন ড্যাপের কারণে ২০২৩ সাল থেকেই আমাদের আবাসন খাত মন্দা, যার কারণে রাজউকে নতুন প্ল্যান পাস করানো বন্ধ রাখেন উদ্যোক্তারা। ফলে এ সময়ে যে পরিমাণ প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল সেই রকম হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ড্যাপ সংশোধন করার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। আমরা আশা করছি, দ্রুতই এটি পরিবর্তন হবে, এতে এই খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ’

নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এনজাক ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মামুনুর রশিদ বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রী রড ও সিমেন্টের উচ্চমূল্যের কারণে কয়েক বছর ধরেই এই খাতের অবস্থা খারাপ। তবে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী টানা আন্দোলনের পর নতুন সরকার গঠন করার পর আবাসন খাতের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ, আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, আমলারা এখন টাকা ধরে রেখেছে। কোথাও বিনিয়োগ করছে না। সাধারণ মানুষ, যারা ফ্ল্যাট কেনার চিন্তা করেছিল, তারাও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে কেনার সাহস করছে না। অন্যদিকে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়ায় দেশে নতুন ফ্ল্যাটের কিছুটা সংকটও রয়েছে। যদিও এখন ফ্ল্যাটের চাহিদা না থাকার কারণে সেটি বোঝা যাচ্ছে না। যখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে তখন ফ্ল্যাটের সংকটটি বোঝা যাবে। ’

ফ্ল্যাট বিক্রি ও বুকিংয়ের পাশাপাশি প্লট বা জমি বিক্রির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে কমে গেছে। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের নির্বাহী মহাব্যবস্থাপক ফাহাদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে সামগ্রিকভাবেই সব ধরনের ব্যবসায় এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। আবাসন বিনিয়োগের বড় একটি খাত। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের পরিবেশ তেমন না থাকায় মানুষের প্লট কেনায় মনোযোগ কম। আমরা ব্যবসা নিয়ে সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। আশা করছি, শিগগিরই দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে ব্যবসা। ’

এদিকে গত মাসে ঢাকার আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পাঁচ দিনব্যাপী রিহ্যাব আবাসন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় অংশ নেওয়া ডেভেলপাররা জানিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে, এমন কম্পানিগুলোর ছোট ও মাঝারি ফ্ল্যাট বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে। আর ১০ কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাট বিক্রি কমেছে ৫০ শতাংশ।

গ্রীন হাট রিয়েল এস্টেটের পরিচালক মেজবা উদ্দিন মারুফ বলেন, ‘২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ফ্ল্যাট বিক্রি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে। আগে যেখানে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে আটটি ফ্ল্যাট বিক্রি হতো, এখন তা কমে দুটিতে দাঁড়িয়েছে। যাদের খুবই প্রয়োজন, তারা এখন কিনছে। আর যাদের নিজেদের ফ্ল্যাট আছে, তারা নতুন করে কম কিনছে। ’

এই প্রতিষ্ঠানের ৩০টির বেশি প্রকল্প চলমান রাজধানীতে। সেখানে প্রায় ২০০ ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য রয়েছে। বনশ্রীতে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে ছয় হাজার টাকা, বসুন্ধরায় সাত হাজার ৫০০ থেকে ৯ হাজার টাকা এবং জলসিঁড়ি আবাসনে ৯ হাজার ৫০০ টাকা। এসব ফ্ল্যাটের আয়তন এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০ বর্গফুট, আর জলসিঁড়ি আবাসনে দুই হাজার ৮৫০ বর্গফুট। ’

শেলটেক (প্রা.) লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা শাহজাহান রায়হান বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এক বছর আগের তুলনায় ২০২৪ সালে বিক্রি ২০ শতাংশ কম। গ্রাহকরা এখন এই খাতে বিনিয়োগ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। ’

এদিকে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের কাজেও স্থবিরতা চলছে। রাজধানীর কুড়িল এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম রাসু চলতি জানুয়ারিতে বাড়ির কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণে বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দামে রড ও সিমেন্ট পাওয়ার আশায় এক ডিলারকে অগ্রিম টাকা জমাও দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে আপাতত নতুন বাড়ির পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন তিনি।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৫

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।