ঢাকা: গত সাড়ে ১৫ বছরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে জুলাই অভ্যুত্থানে পতিত হাসিনা সরকার। ১৮ কোটি মানুষের রক্ত-ঘাম ঝরানো করের টাকার যথেচ্ছ অপব্যয়ে এবং প্রকল্পের নামে পকেট ভারী করেছে ফ্যাসিস্ট সরকার।
দেশের অর্থনীতি বড় হবে, আসবে বড় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান হবে, কর্মসংস্থান হবে— এসব বুলি আওড়ে নেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগাপ্রকল্প। কিন্তু এসবের নাম করে তথ্যের গোঁজামিলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে বৃহত্তর কাগুজে অর্থনীতি।
প্রকৃতপক্ষে এর বেশির ভাগই মিছে। বাস্তবে হয়েছে লুটপাট; ধ্বংস করা হয়েছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট সুশাসন তথা দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রতিবেদনে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। এই শুমারির প্রাথমিক ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে বুধবার (২৯ জানুয়ারি)।
পরিসংখ্যান ভবনে অনুষ্ঠেয় এই আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে উৎপাদন খাতে মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৯৭ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাবে গত অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৩২ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকায়। ১১ বছরে উৎপাদন খাতের মোট উৎপাদনমূল্য প্রায় ৫.৭৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এক্ষেত্রে সরকার প্রতিবছর গড়ে ১৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনাভাইরাসের প্রভাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ধস নামার বছরেও এই খাতে ৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল। এছাড়া প্রতিবছরই উৎপাদন খাতে ডাবল ডিজিট, এমনকি কোনো কোনো বছর ১৮ শতাংশ ছুঁই ছুঁই প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। এই সময়ে মোট জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অবদান ১৭.২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলেও দাবি করে হাসিনা সরকার।
উৎপাদন খাতের হাত ধরে শিল্প খাতে বছরের পর বছর ধরে দেখানো জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই হিসাব মিলছে না বিবিএস পরিচালিত অর্থনৈতিক শুমারি-২০২৪-এর প্রাথমিক ফলাফলে।
আজ প্রকাশিতব্য অর্থনৈতিক শুমারির প্রাথমিক হিসাব বলছে, গত ১১ বছরে উৎপাদন খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের (প্রতিষ্ঠান) সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ১৫.৩৯ শতাংশ। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিচালিত শুমারির তুলনায় ২০১৩ সালের শুমারিতে এই খাতে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বেড়েছিল ১০০.৪২ শতাংশ।
সার্বিকভাবে দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টিতে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এ হিসাবে ১১ বছরে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৯টি বা ৫১.৯১ শতাংশ বেড়েছে।
এর আগের জরিপে (২০১৩) দেশে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ৪১ লাখ ১০ হাজার ৪২১টি বেড়েছিল, যা ২০০৩ সালের ৩৭ লাখ আট হাজার ১৪৪টি ইউনিটের তুলনায় ১১০.৮৫ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি হওয়ায় অর্থনৈতিক ইউনিটে এই খাতের অবদান ৮.৭৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটে উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১২.১৪ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ১১.৫৪ শতাংশে নেমে আসে। এ হিসাবে টানা দুই শুমারিতেই কমেছে উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানের অবদান।
গত ১১ বছরে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৮২ থেকে ৫৬.৬৮ শতাংশ বেড়ে এক কোটি আট লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৬-এ দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। এর ফলে মোট প্রতিষ্ঠানে সেবা খাতের অবদান ৮৮.৮৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১.২৩ শতাংশে।
গেল এক দশকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে ৪০ লাখ কোটি টাকা। এই সময়ে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের যুক্ত হয়েছে ৪০ লাখ ৫৮ হাজার খানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সার্ভিস তথা সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে ৩৯ লাখ ১৯ হাজারটি আর উৎপাদন খাতে যুক্ত হয়েছে মাত্র এক লাখ ৩৮ হাজারটি। এ কারণে গত ১০ বছরে মাত্র ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
অর্থনীতিবদরা বলছেন, বিগত সময়ে জিডিপির আকার যে হারে বেড়েছে, সেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র বাড়েনি। এ কারণে প্রত্যাশা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। তাই বেকারের পরিসংখ্যান লম্বা হচ্ছে। অর্থাৎ গত ১১ বছরে যেখানে সাড়ে ৬২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, আগের ১০ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছিল এক কোটি ৩৩ লাখ। টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে এই অবস্থার উন্নতি করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক শুমারি প্রকল্পের পরিচালক এস এম শাকিল আখতার বলেন, গত ১০ বছরে বড় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। নানা কারণে উৎপাদন খাত বাড়লেও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। এতেই বোঝা যায় অর্থনৈতিক অগ্রগিত হয়নি।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জিডিপির আকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ইউনিট বেড়েছে এটি ইতিবাচক। তবে সব সময় প্রত্যাশা থাকে দেশে শিল্প বাড়ুক, ছোট কম্পানি থেকে মাঝারি, আবার মাঝারি কম্পানিগুলো বড় কম্পানি হয়ে উঠুক। কিন্তু অর্থনীতির আকারের সঙ্গে শিল্পের আকার সেভাবে বাড়েনি। এটি অর্থনীতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে শিল্প-কারখানায় উন্নয়ন হচ্ছে না। অর্থনীতির আকারের সঙ্গে শিল্পায়ন না হওয়ার পেছেন সরকারের প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা রয়েছে। নীতি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে।
অর্থনৈতিক শুমারির প্রতিবেদন মতে, গত এক দশকে অর্থনৈতিক ইউনিট বেড়েছে ৪০ লাখ ৫৮ হাজারটি। এর মধ্যে সেবা খাতে বেড়েছে ৩৯ লাখ ১৯ হাজারটি আর উৎপাদন খাতে বেড়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৫টি; অর্থনৈতিক ইউনিট বাই টাইপে এক কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৪টি। এর মধ্যে পার্মানেন্ট ৬২ লাখ ৮৮ হাজার ২১৪টি, টেম্পরারি পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টি। ইকোনমিক হাউসহোল্ডে ৫০ লাখ ১২ হাজার ৫২৯টি। ঠিক এর এক দশক আগে প্রতিষ্ঠান ছিল ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে পার্মানেন্ট ছিল ৪৫ লাখ ১৪ হাজার ৯১টি, টেম্পোরারি ছিল চার লাখ ৮২ হাজার ৯০৩টি। আর ইকোনমিক হাউসহোল্ড ছিল ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫৭১। অর্থাৎ ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯৯টি অর্থনৈতিক ইউনিট বেড়েছে।
অর্থনৈতিক ইউনিটের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৮৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৬১টি, আর শহরাঞ্চলে রয়েছে ৩৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৩টি। এর আগে ২০১৩ সালে গ্রামাঞ্চলে ছিল ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার ১৯টি, শহরাঞ্চলে ছিল ২২ লাখ ২৯ হাজার ৫৪৬টি। স্থানীয় বা পার্মানেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৩৯ লাখ ৪১ হাজার ৬৮টি, শহরাঞ্চলে রয়েছে ২৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৪৬টি; যা ১০ বছর আগে ছিল গ্রামাঞ্চলে ২৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪৫৯টি আর শহরাঞ্চলে ছিল ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৬৩২টি। টেম্পোরারি পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৬২১টির মধ্যে শহরাঞ্চলে রয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯০৯টি আর গ্রামে দুই লাখ ৯১ লাখ ৭১২টি; যা ২০১৩ সালে ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৬৯৩টি।
প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৪ সালে তিন কোটি সাত লাখ ৬১ হাজার ৩৪ জন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এর মধ্যে পুরুষ দুই কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ২৯৮ জন। মহিলা ৫১ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৭ জন, হিজড়া দুই হাজার ৫৯ জন।
এর আগে ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছিল এক কোটি ৩৩ লাখ। আর ২০১৩ সালে এসে কর্মসংস্থান দাঁড়ায় দুই কোটি ৪৫ লাখ ৮৫০। সে হিসাবে গত ১০ বছরে নতুন কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৬২ লাখ ৬০ হাজার ১৮৪ জন।
শিল্প খাতে গত ১১ বছরে এক লাখ ১৬ হাজার ৯৭৮টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২৫
এএটি