ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

সবুজ বিলে দালালদের ‘কুনজর’!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৫ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭
সবুজ বিলে দালালদের ‘কুনজর’! বয়ইররা বিলে সবুজ ফসলের সমারোহ

মিরসরাই (চট্টগ্রাম): সৈদালী গ্রামের কৃষক নূর হোসেন। বয়ইররা বিলের ১২ একর জমিতে বর্গা চাষ করে তাঁর সংসার চলে। গত মৌসুমে দারুণ ফলেছে ধান। এ মৌসুমে তার জমিজুড়ে মরিচ, ঢেঁড়শ, টমেটো আর নানাজাতের ডালের চাষ করেছেন।

আগাম বৃষ্টি কিছুটা ক্ষতির মুখোমুখি ফেললেও লোকসান গুনতে হবে না। বৃষ্টির আগেই ঘরে উঠেছে ফসলের ৭৫ ভাগ।

তবুও তার মাথায় চিন্তার ভাঁজ। এক শ্রেণীর জমির দালাল (জমি বিক্রির মধ্যস্বত্বভোগী) বিলের জমিতে সীমানা পিলার পুঁতে চারদিক পরিমাপ করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মায়ানী ইউনিয়নের সৈদালী গ্রামের বয়ইররা বিলে মিলকারখানা স্থাপনে আগ্রহী একটি কোম্পানীর জন্য জমি ক্রয় করছে স্থানীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। তারা গ্রামের নিরীহ জমি-মালিকদের পরিবারের সদস্যদের চাকুরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে জমি হাতিয়ে নেয়ার ফন্দি আঁটছে। এরই মধ্যে বিলের কয়েক খন্ড জমি ক্রয়ও করেছে তারা।

কয়েকদিন আগে বয়ইররা বিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলজুড়ে সবুজ ফসলের সমারোহ। কোনো জমিতে মরিচ, টমেটো আর সাদা কুমড়ার সমন্বিত চাষ। কোথাও আবার লাউ, ঢেঁড়শ আর মরিচের চাষ। আবার কিছু কিছু জমিতে ইরি ধান চাষ করেছেন কোনো কোনো কৃষক।

কৃষক ফজলুল হক চাষ করেন বিলের আড়াই একর জমি। তিনি বলেন, ‘গত একমাস ধরে একদল লোক জমি কেনার কথা বলে হাটেমাঠে সবখানে বিরক্ত করছেন। এ বিলের জমিতে তিন মৌসুমে ফসল চাষ করে ছেলে-মেয়ে আর বৌ মিলে সাতজনের সংসার চালাই। জমি হারালে না খেয়ে মরতে হবে। ’ বয়ইররা বিলের সবজির ক্ষেতে ব্যস্ত কৃষক
বিলে সাড়ে আট একর জমিতে বর্গা চাষ করেন কৃষক শামীম। তিনি বলেন, ‘শুনেছি জমির মালিক মিলকারখানার জন্যে জমি বিক্রি করে দেবেন। বাপ দাদার আমল  থেকে এসব জমিতে চাষ করে সংসারের খাবার জোগাই। চাষ বন্ধ হলে ছেলেপুলে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। ’

বিলের জমির মালিক পবন জানান, ‘মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের চার লেন বিশিষ্ট সড়কটি (নির্মাণাধীন) বড়তাকিয়া থেকে সৈদালী গ্রাম হয়ে বয়ে গেছে। এ কারণে গ্রামের কৃষিজমির দিকে দৃষ্টি দিয়েছে একশ্রেণীর চতুর লোক। তারা সহজ সরল মানুষজনকে ধোঁকা দিয়ে কিছু কিছু জমি কিনেও ফেলেছে। আমার পৈতৃক জমি আছে এ বিলে। কৃষিজমি বাঁচাতে আমরা গ্রামবাসী একত্রিত হচ্ছি। বিষয়টি আমরা মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামীকেও জানিয়েছি। ’

মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির আহম্মদ নিজামী জানান, ‘মায়ানী ইউনিয়নের বয়ইররা বিল তিন ফসলি কৃষিজমি। তবে আমন মৌসুমে উৎপাদন কম হয়। ’

জমি কেনাবেচা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি বয়ইররা বিলে জমি কেনাবেচার বিষয়টি পরোক্ষভাবে জেনেছি। তবে আমি একজন জনপ্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে তারা আমার সাথেও যোগাযোগ করেনি। শুনেছি ম্যাকড্রাই এবং নাভানা মিলকারখানা স্থাপনের জন্য যৌথভাবে এখানে জমি কেনা শুরু করেছে। ’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি (McDry Desiccant Limited)  মিলকারখানা তৈরির জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে বয়ইররা বিলের জমি ক্রয় করছে। ক্ষেত্রভেদে জমির প্রকৃত দামের চেয়েও বেশি দামে জমি ক্রয় করছে কোম্পানিটি। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে কিছু জমির মালিকের মধ্যস্ততাকারীদের কেউ কেউ জমি বিক্রির জন্য নানাভাবে জোর খাটাচ্ছে।
বয়ইররা বিলের সবুজ ফসলের ক্ষেতে ব্যস্ত কৃষক
জমির ক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের একজন মোহাম্মদ পায়েল। এ বিষয়ে তার সাথে কথা বললে তিনি ম্যাকড্রাই লিমিটেড নামের কোম্পানির জন্য জমি ক্রয়ের কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি জোরপূর্বক জমিক্রয় করার অভিযোগের সত্যতা  অস্বীকার করেন।

এদিকে কৃষিজমি রক্ষার জন্য দেশে কার্যকর কোনো আইন নেই বললেই চলে। ভূমি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমির শ্রেণি পরিবর্তনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিধান ভূমি ব্যবস্থাপনা আইনে নেই। তবে ২০১৬ সালে কৃষিজমি সুরক্ষা ও ব্যবহার আইন নামে একটি আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। তবে এ আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি বলে জানিয়েছেন তারা।

মিরসরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কায়সার খসরু বলেন, ‘আমার অবস্থান থেকে জমির শ্রেণি পরিবর্তনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। ’ ২০১৬ সালে অনুমোদিত খসড়া আইন সম্পর্কে জানতে চাইলে এ ভূমি কর্মকর্তা বলেন, ‘এ আইন সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে যেহেতু আপনার (প্রতিবেদক) মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি, আমি খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১৭
এসএইচডি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।