প্রায় ৭ হাজার ২১৮টি কৃষক পরিবার তিন ফসলি এসব জমিতে মৌসুমভিত্তিক ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু কতিপয় প্রভাবশালী ফসলি জমির পাশে পরপর ছয়টি ইটখোলা গড়ে তুলেছেন।
এতে করে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে। বিশাল এলাকাজুড়ে পরিবেশ দূষণ ঘটছে। ইটভাটার ছাইয়ে ঢেকে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসল। বাতাসে ছড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া ও ছাই। শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে কষ্ট পাচ্ছে মানুষ।
ফসলি জমিকে খাল ও জলাবদ্ধ এলাকা হিসেবে দেখিয়ে এই প্রভাবশালীরা ইটখোলা নির্মাণের অনুমতি চান। তাতেই কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারাও প্রকৃত অবস্থা যাচাই না করে ছাড়পত্র দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়াই এরা ইটখোলা বানিয়েছেন। ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল)কেটে তা দিয়ে তারা ইট তৈরি করায় জমির পুষ্টি উপাদান শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই জমি আর চাষ উপযোগী থাকবে না।
প্রতিকার চেয়ে কুড়িগাতি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আমিরুল ইসলাম সোমবার (০৬ নভেম্বর) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (০৯ নভেম্বর) উপজেলা কৃষি অধিদফতরের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে জানান, কৃষি অফিস থেকে কোনো ব্যক্তিকে ইটখোলা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। খাল বা জলাবদ্ধ বিল এলাকা দেখিয়ে ইটখোলার মালিকরা আবেদন করেছেন। অনুমতির জন্য পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়, বগুড়া বরাবর প্রতিবেদন পাঠানো হযেছে। চলতি বছর পাঁচটি ইটখোলার মালিককে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে তা অনুমতিপত্র বা ছাড়পত্র নয়। পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনই শুধু ইটখোলার অনুমতি দিতে পারে। কৃষকদের ক্ষতি হয়ে থাকলে নতুন করে তদন্ত করে প্রত্যয়নপত্র বাতিল করা হবে।
অথচ অভিযোগ উঠেছে, কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট এলাকার উপ-সহকারী ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জলাবদ্ধতা দেখিয়ে ইটখোলার মালিকদের ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন। আর তা পেয়েই চলতি বছর নির্মাণ করা হয়েছে জহুরুল ইসলামের ফাইভ স্টার, মিজানুর রহমানের প্রগতি, ফারুক হোসেনের বন্ধু আব্দুল মালেকের দিগন্তসহ আদর্শ, একতা নামের ইটখোলা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিয়া সুলতানা অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, কৃষিজমিতে ইটখোলা নির্মাণের সুযোগ নেই। কৃষি কর্মকর্তাকে অভিযোগ তদন্ত করে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, মথুরাপুর ইউনিয়নের কুড়িগাতি-জোলাগাতি মৌজায় প্রায় দুই হাজার একর অতি উর্বর জমিতে ধানসহ নানা জাতের ফসল ফলে। এসব জমি সংলগ্ন মাঠের ভেতর দিয়ে কুড়িগাতি নামের একটি খাল প্রবাহিত। এই খাল হয়ে আবাদি জমি ও মাঠের পানি বাঙালি নদীতে যায়। তাই এখানকার জমি বা মাঠে কখনও জলাবদ্ধতা হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কৃষক বাংলানিউজকে জানান, এসব ইটখোলার মালিকরা প্রথমে কিছু জমি ক্রয় করেন। এরপর বাড়তি টাকা দিয়ে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কিছু জমি ইজারা নেন। এখন আশেপাশের জমি বেদখলের চেষ্টা করছেন। ভয়ে কৃষকরা তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না।
অভিযোগকারী কৃষক আমিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, তার ৫০ শতক ফসলি জমি ও ৩৬ শতক গাছের বাগান রয়েছে। এছাড়া হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগল লালন পালন করে তিনি সংসার পরিচালনা করেন। চলতি বছর তার জমি ঘিরে অবৈধভাবে দিগন্ত নামের একটি ইটখোলা নির্মাণ করা হয়। ইটখোলার মাঝামাঝিতে পড়ায় কৌশলে তার জমিটি স্বল্প দামে কিনে নিতে চান ইটখোলা মালিক আব্দুল মালেক। ধুলোবালিতে তার জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। বসতবাড়িতে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগি পালনেও দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। পরিত্রাণ চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে আবেদন করেছেন তিনি।
দিগন্ত ইটখোলার মালিক আব্দুল মালেক অবশ্য বলছেন, কৃষকদের অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা পরিবেশ অধিফতরের অনুমতি না পেলেও কৃষি অফিসের অনুমতি নিয়েই ইটভাটা নির্মাণ করেছি।
পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়, বগুড়ার পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, ওই এলাকায় কৃষিজমিতে ইটখোলা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী বাংলানিউজকে জানান, অনুমোদন না থাকলে ইটখোলাগুলো ভেঙে দেওয়া হবে। দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলার সিভিল সার্জন ডা. সামছুল হক বাংলানিউজকে জানান, ইটখোলার পানি শরীরে লাগলে চর্মরোগ দেখা দেবে। পেটের ভেতর পানি ঢুকলে ডায়রিয়া, বমিসহ নানা ধরনের জটিল রোগ হবে। ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট কার্বনে শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৭
এমবিএইচ/জেএম