ভেষজ বিপ্লবকারী নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামটি তাই এখন ‘ঔষধিগ্রাম’ নামেই বেশি পরিচিত।
নাটোর: ভেষজ-ঔষধি গাছের রমরমা চাষ ও সেগুলো থেকে কবিরাজি-আয়ুর্বেদি ওষুধ উৎপাদনের প্রাচুর্যে পাল্টে গেছে একটি গ্রামেরই নাম! উন্নত হয়েছে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মান, স্বাবলম্বী হয়েছেন বাসিন্দারা।
ভেষজ বিপ্লবকারী নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামটি তাই এখন ‘ঔষধিগ্রাম’ নামেই বেশি পরিচিত।
লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের দেখাদেখি একই ইউনিয়নের আরও কয়েকটিসহ পাশের বড়হরিশপুর ইউনিয়নের কয়েকটি মিলে মোট ২০টির মতো গ্রাম এ ভেষজ বিপ্লবের অংশীদার হয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নাটোর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি আবাদি জমি, বাড়ির আনাচে-কানাচে, বেড়া অথবা রাস্তার পাশের ঝোপ-ঝাড় ঔষধি গাছে ভরপুর।
শহর থেকে বিভিন্ন যানবাহনে প্রধান সড়ক বা গ্রামীণ সড়কপথ ধরে খুব সহজেই যাওয়ার সুবিধা থাকায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে সারা বছরই জমজমাটও থাকছে গ্রামটি।
লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামবাসী জানান, বছর পঁয়ত্রিশেক আগে কবিরাজি চিকিৎসার কাজে মাত্র ৫টি ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করেছিলেন সদ্য প্রয়াত ভেষজ চিকিৎসক আফাজ উদ্দিন। শিগগিরই তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামজুড়ে।
ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে এখন সারা বছরই ১৪০ প্রজাতির ভেষজ গাছের চাষ হচ্ছে এ গ্রামে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্বর্ণলতা, উলটকম্বল, শতমূল, মিছরিদানা, তুলসী, থানকুঁচি, জার্মানিলতা, হরিতকি, বহেরা, আমলকি, চিরতা, তালমাখনা, তেলাকুঁচি, বাসক, অশ্বগন্ধা, সাদা লজ্জাবতী, লাল লজ্জাবতী, হস্তিগন্ধা, তেজবল, দুধরাজ, নাগেশ্বর, আমরুল, ঘোড়াচাণ্ডাল, কালো ধুতরা, ঘিয়া বাবলা, লতা কস্তুরি, আলকুঁচি, অপরিচিতা, পাথরকুঁচি, ভূঁইকুমড়ো ইত্যাদি। তবে ঘৃতকুমারী, শিমুল মূল ও অশ্বগন্ধার চাষই বেশি হয়।
ঔষধি গাছের চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ওষুধ উৎপাদনে জীবিকা নির্বাহ করছেন গ্রামটির ২৫০ জন নারী শ্রমিকসহ অন্তত ১ হাজার ৬০০টি পরিবার। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রির দোকান।
বাণিজ্যিক সুবিধায় গঠিত ‘ভেষজ বহুমুখী সমবায় সমিতি’র মাধ্যমে সমন্বিতভাবে রীতিমতো ভেষজ বিপ্লব করে ফেলেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা আর উৎপাদনকারীরা।
স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, শুধু ঔষধি গ্রাম লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়ার ২ হাজার ৩৭ বিঘা জমিতেই বছরে ২৪ হাজার ৪৫৭ মেট্রিকটন বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদিত হচ্ছে।
এর মধ্যে ১ হাজার বিঘা জমিতে ২৪ হাজার মেট্রিকটন ঘৃতকুমারী, ২০০ বিঘা জমিতে ১৪৮ মেট্রিকটন অশ্বগন্ধা, ৫০০ বিঘা জমিতে ১০০ মেট্রিকটন শিমুল মূল এবং বাকি জমিতে অন্যান্য ভেষজ উৎপাদিত হয়। এ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৪ হাজার ৫০০ জন কৃষক, ২০ জন নার্সারি মালিক, ৩০ জন ছোট-বড় ব্যবসায়ী ও ৩০ জন প্রক্রিয়াজাতকারী।
সদর উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাব মতে, খোলাবাড়িয়াসহ কয়েকটি গ্রামের ৬৫ হেক্টর জমিতে ১৩ হাজার ১৩০ মেট্রিকটন ঘৃতকুমারী, ৫৩ হেক্টরে এক হাজার ২৭২ মেট্রিকটন শিমুল মূল, ১০ হেক্টরে ১৮ মেট্রিকটন অশ্বগন্ধা, ৫ হেক্টর জমিতে ৫০ মেট্রিকটন মিশ্রিদানা এবং ৭ হেক্টরে ১৪০ মেট্রিকটন অন্যান্য ভেষজ উৎপাদিত হয়। ৩৯৫ জন গাছ উৎপাদক, ১৫ জন বীজ সরবরাহকারী, ৯ জন চারা উৎপাদক, ১২ জন পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী, ২২ জন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, ২৫০ জন ফঁড়িয়া এবং ১৭ জন কবিরাজ এ কাজে জড়িত।
তবে কৃষকরা বলছেন, তাদের হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মেহেদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, খুব শিগগিরই তাদের ভেষজ গাছ ও পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু হবে। কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করছে কৃষি বিভাগ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
এএসআর