ধানের জমিতে চার দিন চাষ করে ধান লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে পানের জমিতেই কেবল চাষের প্রয়োজন হয় না।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ী ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের আবদুল হাকিমসহ তিনজনের প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিনা চাষে ধানের আবাদ চলছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের উদ্যোগে ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় আবদুল হাকিমসহ অন্যরা এবার ব্রি-৭১ ও ব্রি-৩৯ জাতের ধান লাগিয়েছেন। এর মধ্যে ব্রি-৭১-এর ফলন বিঘায় ১৯ মণ, আর ব্রি-৩৯ এর ফলন বিঘায় ১৩ মণ করে হওয়ার কথা রয়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর উপজেলার পাকড়ী ইউনিয়ন ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন দেওয়ান বাংলানিউজকে বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ব্রি-৭১ ধানের ফলন অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। বীজতলা করে জমিতে কাদা করে ধান রোপণ করলে বিঘাপ্রতি ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ২০ মণ পর্যন্ত উৎপাদিত হয়। অথচ বিনা চাষেই হবে ১৯ মণের মতো। চাষ না লাগায় আবদুল হাকিমসহ অন্য তিনজনের বীজতলা ও জমি তৈরির খরচ বাবদ তাদের প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা করে সাশ্রয় হয়েছে।
পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ার ফলে এ ধান খরা প্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। পাট কাটার ১৫ দিন আগে জমিতে কোনো রকম চাষ দেওয়া ছাড়াই ব্রি-৭১ ও ব্রি-৩৯ জাতের ধানের বীজ বপন করা যায়। আর পাট কাটার সময় এই ধানের চারার তেমন ক্ষতি হয় না। কারণ, বীজ ছিটিয়ে বপন করার কারণে চারা অনেক বেশি হয়। এছাড়া ধান কাটার পরে সময়মত রবি শস্যের আবাদও করা যায়। এই পদ্ধতিতে ফলন ভালো হলে আগামী বর্ষা মৌসুমে ব্যাপকহারে বিনা চাষে ধানের আবাদ করার জন্য কৃষকদের সচেতন এবং পরামর্শ দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিনা চাষে ধানের আবাদ করলে ফলন ভালো হয়। এছাড়া এ পদ্ধতি মাটির গুণাগুণ ভালো থাকে। পানি, কীটনাশক, সার ও শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় এই পদ্ধতিতে ধান চাষে অন্য পদ্ধতির মাধ্যমের চাষের থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত একজন কৃষকের সাশ্রয় হবে। এছাড়াও বিনা চাষে অন্য প্রযুক্তির বা পদ্ধতির তুলনায় তিন থেকে চার মণ ধান বেশি উৎপাদন হবে বলেও জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ইতোপূর্বে রবিশস্য যেমন- গম, ভুট্টা, মসুর, কলাই, খেসারী, কালাই, রসুন ও সরিষা ইত্যাদি ফসল করে সাফল্য পাওয়ায় এই বছরে বরেন্দ্র এলাকায় মাত্র সাড়ে তিনবিঘা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিনা চাষে ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ধান গাছের অবস্থা অত্যন্ত ভালো এবং ধানের গোছাগুলো মোটা হয়েছে। একটি গোছাতে প্রায় ৪০-৪৭টি ধানের গাছ রয়েছে। আর প্রতিটি স্টিকে শীষ আসবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সেই সঙ্গে রোগাবালাই নাই বললেই চলে। বর্তমানে ধানের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই চেষ্টা সফল হবে। আর তাহলে আসছে রবি মৌসুমে ১০০ বিঘার ওপরে বরেন্দ্রভূমিতে বিনা চাষে ধানের আবাদ করা হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
এদিকে, গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ী ইউনিয়নের চাতরা দোকানী পাড়ার কৃষক আবদুল হাকিম বলেন, তিনি মাত্র এক বিঘা জমিতে বিনা চাষে ব্রি-৭১ ধানের চাষ করেছেন। প্রথমে পাকড়ী ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার জালাল উদ্দিন বিনা চাষে ধান চাষ করতে বললে তিনি তার কথা বিশ্বাস করেননি।
এর কারণ হিসেবে তিনি জানান বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি অত্যন্ত রুক্ষ। এখানকার মাঠে কোনদিন বন্যার পানি প্রবেশ করেনা। এই অবস্থায় বিনা চাষে বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে ধান চাষ করা সম্ভব নয় বলে তিনি প্রথমে রাজি হননি।
পরে উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম, স্থানীয় কৃষক জাইদুর এবং জালাল উদ্দিনের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনি এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করতে রাজি হন। তবে এখন জমিতে বাড়ন্ত ধান গাছের সবুজ শীষ দেখে এখন তিনি মহা খুশি। প্রতিটি ধানের গোছাতে ৪০-৪৭টি স্টিক রয়েছে। অথচ চারা রোপনের সময় মেশিনের সাহায্যে মাত্র দুই থেকে তিনটি চারা রোপন করা সম্ভব হয় বলেও জানান এই কৃষক।
চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুল হাকিম বলেন, খরা মৌসুমে জমিতে একটি চাষ দিয়ে জমি ফেলে রেখে ছিলেন। এরপর বৃষ্টি শুরু হওয়ার পূর্বে জমির আগাছা পরিষ্কার করেছিলেন। পরে জুলাই মাসে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টি শুরু হলে তিনি জমিতে শুধুমাত্র মই দিয়ে মাটি সমান করে রাইস ট্রান্স প্লান্টার মেশিনের সাহায্যে জমিতে চারা রোপন করেন। তখন চারার বয়স ছিল মাত্র ১৫ থেকে ১৬দিন। এই অল্প বয়সের চারা রোপনে এখন ধানের গোছা মোটা এবং স্টিক বেশি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে বিঘায় ২০ মণ করে ধান হবে বলেও আশা করেন পরীক্ষামূলক ধান চাষ করা এই কৃষক।
সার প্রয়োগ প্রশ্নে তিনি বলেন, চারা রোপনের আগে মাত্র একবার পটাশ-২০ কেজি, ডিএপি-২০ কেজি এবং ইউরিয়া সার ১০ কেজি জমিতে দিয়েছিলেন। এই পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে রোগ বালাই ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ খুব কম হয়। সংক্রমিত হলে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়া উপজেলার জয়রামপুর গ্রামে কৃষক জাইদুর রহমান বলেন, বিনা চাষে ধানের চাষ করতে হলে ট্রে বা পলিথিনে করে ধানের চারা তৈরি করতে হবে। এ চারা ১৫-১৬ দিনের মধ্যে জমিতে রোপন করতে পারলে মাটিতে এ চারাগুলো দ্রুত বসে যেতে সক্ষম হয় এবং আরও দ্রুত কুঁশি ছড়াতে থাকে। এভাবে ধানের গোছা অনেক মোটা হয় এবং ফলনও ভালো হয়। পাশ্ববর্তী কৃষক হাকিমের জমিতে তিনি নিজেই রাইস ট্রান্স প্লান্টার দিয়ে ধানের চারা রোপণ করে দিয়েছেন বলেও জানান জাইদুর।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৮
এসএস/আরআইএস/