এই খামারে আছে বিশ্বের সেরা অন্তত ১৩ জাতের আম গাছ, চার জাতের লেবু, দুই জাতের ড্রাগন ছাড়াও পেয়ারা, সফেদা, আমড়া, কমলা, মালটা, লিচুসহ প্রায় ১২ জাতের সুস্বাদু পুষ্টিকর ফলের গাছ। আছে মাছের পুকুর, এছাড়াও খামারে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা হয়েছে দেশি মুরগির খামার।
খামারের উদ্যোক্তা পুলক বড়ুয়া বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে এই খামারে উন্নত জাতের অন্তত ১৩ জাতের আমগাছ আছে। এছাড়াও আছে কলম্বো, জারা, বীজশূন্যসহ চার জাতের ১ হাজার ১০০ লেবু গাছ, বারি ও বাউ প্রজাতির ১৫০টি ড্রাগন, ১০০টি কমলা ও মালটা এবং ১৬টি সফেদাসহ ১৫ রকমের ফলের গাছ।
প্রায় ১৫ রকম ফল গাছের সঙ্গে এই খামারে উন্নত বাউ-৫ জাতের ৫৫-৬০টি পেয়ারা গাছ আছে। যেগুলো লাগানো হয়েছে মূলত পাখিদের জন্য। পাখিরা খাওয়ার পর বাকি থাকলে পাশের উপজাতীয় গ্রামগুলোতে গর্ভবতী মা ও শিশুদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এরপরেও থাকলে সেগুলো বিক্রি করা হয়-বললেন পুলক।
পুলক আরও বলেন, দুর্গম এই জনপদে গর্ভবতী মা ও শিশুদের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি খামারে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে আমাদের প্রকৃতিপ্রেমী এক বন্ধু ‘মধুপোক’ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী, সর্বজন পত্রিকার সম্পাদক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামানের অনুপ্রেরণা এবং সহযোগিতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। যে কারণে মাত্র বছর তিনেকের মধ্যে এই খামারে নানা রকম পাখি আসা শুরু করেছে। বিশেষ করে সকালে ঘুঘু, বুলবুলি, বাবুই, শালিক, টিয়া, পানকৌড়ির গুঞ্জনে খামারে অনন্য রকম আবহের সৃষ্টি হয়।
খামারের উদ্যোক্তা কারিগরি সমন্বয়ক পুলক বড়ুয়া বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে এই খামারে ১২০টি আমগাছ থেকে ১ মেট্রিক টন ফল পাওয়া যায়। তিন বছর পরে গাছগুলো পরিণত হলে অন্তত ১০ মেট্রিক টন আম সংগ্রহ করা যাবে। আর তখন লেবুর সংখ্যা হবে প্রায় ৪ লাখ। আশা করছি আগামী তিন বছরে এ খামার থেকে বছরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হবে।
খামারের ফলজ গাছের বেশির ভাগই সংগ্রহ করা হয়েছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা ও কক্সবাজার ব্র্যাক নার্সারি থেকে।
পুলক বলেন, এই খামারের প্রধান বৈশিষ্ট্য এখানে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ৯৫ ভাগ জৈব সার ব্যবহার করা হয়। অর্গানিক পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ পুষ্টিকর ফল উৎপাদনই আমাদের লক্ষ্য।
যেভাবে শুরু
২০১৪ সালে তিন বন্ধু পুলক বড়ুয়া, অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার কাজল বড়ুয়া ও ব্যবসায়ী তাপস বড়ুয়া মিলে প্রথমে দুই একরের একটি জমি বর্গা নেন। প্রথম বছর ৬০টি স্থানীয় জাতের পেঁপে, ১ হাজার লেবুর চারা এবং অর্গানিক উপায়ে শীতকালীন সবজির খেত দিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করেন তারা। খামারে ঘেরা-বেড়া, অবকাঠামো নির্মাণসহ সবমিলে খরচ হয় প্রায় ১০ লাখ টাকা। শুরুতেই পেঁপের অভাবনীয় ফলন হয়। পেঁপে চাষে সাফল্যের জন্য প্রথম বছরই বান্দরবান জেলা কৃষি বিভাগ পুরষ্কৃত করে তাদের। কিন্তু পর পর দুই বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় পেঁপে বাগান।
পুলক বড়ুয়া জানান, শুরুতেই বড় হোঁচট খেলেও আমরা হাল ছাড়িনি। পরবর্তীতে পৈত্রিক সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে আরও ১০ লাথ টাকা সেই খামারে বিনিয়োগ করি। পাঁচ বছর কঠোর পরিশ্রম এবং পরিচর্যার পর খামারের আজ এই অবস্থা।
তিনি বলেন, মূলত তিন বন্ধু মিলে এই খামার শুরু করলেও শুরু থেকেই আজ পর্যন্ত আর্থিক সহায়তাসহ আমাদের নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে ঢাকার বন্ধু আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান।
প্রকৃতিপ্রেমী ও ঢাকা মধুপোক প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান রাসেল বাংলানিউজকে বলেন, নানা রকম পাখির কলরব শুনতে সুযোগ পেলেই ঢাকা শহরের এই যান্ত্রিকতা ছেড়ে সেখানে চলে যাই। ওখানে গেলে প্রকৃতির স্বর্গে আছি বলে মনে হয়।
তিনি বলেন, খামারের উদ্যোক্তা পুলক বড়ুয়া শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, মানুষের জন্য যে মানবিকতা দেখিয়ে চলেছেন, তা এই সময়ে বিরল দৃষ্টান্ত।
স্থানীয় বানিয়া ঝিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উছিংমং বাংলানিউজকে জানান, এক সময় জমিটি ঝোপে ঘেরা ছিল। ভয়ে কেউ ওইদিকে যেতে চাইতো না। এখন জায়গাটি মানুষের দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। খামারটি দেখার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ আসছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমি বেশ কয়েকবার ওই খামারে গিয়েছি। সোনাইছড়ির মতো দুর্গম জনপদে, তামাকের রাজ্যে এই খামারটি এখন সবুজের আলো ছড়াচ্ছে। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করেও প্রতিটি ফলের গাছ এতটা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে তা না দেখলে বোঝা যাবে না।
তিনি বলেন, সোনাইছড়িকে ঘিরে সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। এটি হয়ে গেলে এই খামারকে ঘিরে সোনাইছড়িতেই পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা কৃষি বিভাগের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুলাল বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, কৃষি সেক্টরে পুলক এখন পুরো উপজেলায় অনুসরণীয়। তার দেখাদেখি ওই এলাকার অনেক তামাক চাষি তামাক ছেড়ে ফলজ বাগান করছেন। আরো শত শত মানুষ উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন ফলজ বাগানের দিকে। কঠোর পরিশ্রমের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তাদের এই চেষ্টা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের একটি মডেল সমন্বিত খামারে পরিণত হবে। পাশাপাশি এই খামার থেকে আয় হবে লাখ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৯
এসবি/আরআর