যদি আমন মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদনের পর সঠিক মূল্য না পায়, তাহলে কৃষক শেষ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। চলতি আমন মৌসুমে এ বছর দুই লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ৭ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
গেলো ইরি-বোরো মৌসুমে জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান আবাদ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, তাদের লক্ষ্যমাত্রার চাইতে জেলায় ইরি-বোরো ধান আবাদ বেশি হয়েছে। তবে আবাদ বেশি হলেও কৃষকরা বাজারে সঠিক দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা ব্যাংকগুলো থেকে ঠিক মতো ঋণ না পেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদন করেন। কিন্তু ফসলের সঠিক দাম না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন জেলার অধিকাংশ কৃষক। জেলার বেশ কিছু এনজিও কৃষকদের সহজ-সরলতার সুযোগ নিয়ে ঋণের বিনিময়ে তাদের মাথায় বসিয়ে দিচ্ছেন মোটা অংকের সুদের হার।
দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি আমন মৌসুমে জেলার ১৩টি উপজেলার দুই লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে ৭ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৬২৮ হেক্টরে ৪২ হাজার মেট্রিক টন হাইব্রিড, দুই লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সাত লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন উফশী এবং তিন হাজার হেক্টর জমিতে পাঁচ হাজার ২২১ মেট্রিক টন স্থানীয় জাতের আমন ধান উৎপাদনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, সদর উপজেলায় ২৮ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে ৭৯ হাজার মেট্রিক টন ধান, চিরিরবন্দরে ২৪ হাজার ৬৩২ হেক্টর জমিতে ৭০ হাজার মেট্রিক টন ধান, পার্বতীপুরে ২৯ হাজার ২৮৭ হেক্টর জমিতে ৮৩ হাজার ৪৪৫ মেট্রিক টন ধান, বীরগঞ্জে ৩১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ৯০ হাজার ৬০৫ মেট্রিক টন ধান, বিরলে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ধান, নবাবগঞ্জে ২২ হাজার ৮২১ হেক্টর জমিতে ৬৫ হাজার ৩৮৫ মেট্রিক টন ধান, ফুলবাড়ীতে ১৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার মেট্রিক টন ধান, বিরামপুরে ১৮ হাজার ৭৫১ হেক্টর জমিতে ৫৩ হাজার ২৩০ মেট্রিক টন ধান, খানসামায় ১৪ হাজার ৬৩৫ হেক্টর জমিতে ৪২ হাজার মেট্রিক টন ধান, কাহারোলে ১৬ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন ধান, বোচাগঞ্জে ১৭ হাজার ৭৭২ হেক্টর জমিতে ৫০ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন ধান, হাকিমপুরে ৮ হাজার ৪৬২ হেক্টর জমিতে ২৪ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন ধান এবং ঘোড়াঘাট উপজেলায় ১৩ হাজার ৩৭ হেক্টর জমিতে ৩৭ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন আমন ধান আবাদের ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলার কমলপুর, শিকদারহাট, বিরল উপজেলার ফরক্কাবাদ, চিরিরবন্দর উপজেলার বিনাইল ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ইরি-বোরো ধানের দাম না পাওয়ায় লোকসানের বোঝা নিয়ে জেলায় শুরু হয়েছে চলতি আমন মৌসুমের বীজতলা তৈরির কাজ। একদিকে চলছে ছোট জমিতে বীজতলা তৈরির কাজ। অন্যদিকে সেই বীজতলা রোপণের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে অন্যান্য জমি।
গত তিনদিন ধরে জেলায় স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকের জমিতে পানি জমাট বাঁধছে। ফলে বীজতলা তৈরি ও রোপণের জন্য খরচের পরিমাণ কিছুটা কমেছে কৃষকদের। কয়েকদিন আগে কৃষকরা বিভিন্ন নলকূপ ও শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে ছিল।
কাহারোল উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের কৃষক আকবর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ইরি-বোরো মৌসুমে স্থানীয় এনজিও ‘পল্লী শ্রী’র কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ফসল উৎপাদনের পর বাজারে ধানের দাম না পেয়ে নিজের ১৫ শতক জমির মধ্যে ৮ শতক জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রতি শতক জমি মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে তার।
তিনি বলেন, কি আর করবো? ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়েছি তাই বাধ্য হয়ে কম দামে জমি বিক্রি করে দিয়েছি। যদি আমন ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম না পাই তাহলে আমাকে আমার শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হবে।
দিনাজপুর সদর উপজেলার কমলপুর গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ইরি-বোরো মৌসুমের ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে পথে বসে গেছি। এবার আমন ধান আবাদ করতেছি। এরই মধ্যে বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছি। যদি আমন ধানের দাম সঠিক না পাই তাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো। এমনিতে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের ঋণ দিতে চায় না। তাহলে আমরা কি করবো?
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তৌহিদুল ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, রোপা আমনের চলতি মৌসুমে জেলার সব উপজেলায় বীজতলার মাধ্যমে ধানের চারা উৎপাদন শেষের দিকে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে রোপা আমন রোপণের কাজ শুরু হবে। কৃষকেরা ইতোমধ্যে মাঠের জমি তৈরি করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৯
জিপি