জানা যায়, সার আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি গ্রাম-বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার। পাশাপাশি ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৩১৮ কোটি টাকাও শোধ করেনি।
এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বাংলানিউজকে জানান, বেসরকারিভাবে নন-ইউরিয়া সার আমদানিকারকদের ২৭ জুনের মধ্যে এলসি খোলার নির্দেশ দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে এই সময় পেরিয়ে গেলেও প্রভাব খাটিয়ে কোম্পানিটি তিন দিন পরে গ্রাম-বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রা.) লিমিটেড ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্রাম-বাংলা ট্রেডিং জনতা ব্যাংক ভবন শাখার নামে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার এলসি ঋণপত্র খুলেছে। যার কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে দাখিলও করেছে।
এতে বিদেশ থেকে সার না এনেই ব্যাংকের বিপুল অংকের অর্থ লোপাটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আসন্ন কৃষির ভরা মৌসুমে আমদানি সার দেশে না এলে নতুন করে সঙ্কটে পড়ে দেশের লাখো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এতে সারের সংকট মোকাবেলা করে কৃষকের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১১ বছরের সুনাম অক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কাও সংশ্লিষ্টদের।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ২ দশমিক ৭৫ লাখ মেট্রিক টন ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ৪ লাখ মেট্রিক টন ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), ৩ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), শূন্য দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন পাউডার এমএপি সার মিলিয়ে সর্বমোট চার প্রকারের ১১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন নন-ইউরিয়া সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত ১৬ মে আহ্বান করা ওই দরপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, ২৯ মে সকাল ৯টা হতে দুপুর ১টার মধ্যে সিলগালা করা খামে প্রস্তাব দাখিল করতে হবে। তবে সার আমদানির কার্যাদেশ জারির পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাংকে এলসি ঋণপত্র খুলে জামানতের অর্থসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ঋণপত্র খুলতে ব্যর্থ হলে জামানতবাবদ জমাকৃত সমুদয় অর্থ বাজেয়াপ্তসহ মনোনয়ন বাতিল করা হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান পুরোনো ঋণ পরিশোধ না করে কিংবা নতুন করে এলসি ঋণের বিপরীতি সম্পদ বন্ধক ছাড়া নতুন এলসি খুলতে পারবে না।
কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই গ্রাম বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজার অ্যান্ড অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ (প্রা.) লিমিটেড এবং তাদেরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্রাম বাংলা ট্রেডিং মিশর থেকে ২৫ হাজার টন টিএসপি, চীন থেকে ৮০ হাজার টন ডিএপি এবং চীন থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন এমএপি সার আমদানির কার্যাদেশ পায়। তবে আমদানি দরপত্রের নিয়ম না মেনে এলসি খোলার মেয়াদ পার হওয়ার তিন দিন পরে জনতা ব্যাংক ভবন শাখায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার পৃথক চারটি এলসি ঋণপত্রের কাগজ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। (এলসি নম্বর যথাক্রমে ০১৩২১৯০২০০২৯, ০১৩২১৯০২০০৩৫, ০১৩২১৯০২০০৩০, ০১৩২১৯০২০০২৮, তারিখ ৩০ জুন)।
কৃষি মন্ত্রণালয় সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেক আমদানিকারককে ২৭ জুনের মধ্যে এলসি খেলার নির্দেশ দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, ওই তারিখের মধ্যে এলসি খুলতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জামানত বাজেয়াপ্ত করাসহ কার্যাদেশ বাতিল করার কথা বলা হয়। অথচ, নির্ধারিত তারিখের তিনদিন পর ৩০ জুন এলসি ঋণের কাগজপত্র দিয়েছে কোম্পানিটি। সেজন্য সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, কীভাবে কাদের ‘ম্যানেজ’ করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিলো প্রতিষ্ঠানটি, আর মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা কোন উদ্দেশ্যে গ্রহণ করলেন?
এ প্রসঙ্গে জানতে গ্রাম-বাংলা এনপিকে ফার্টিলাইজারের ঢাকার বনানী কার্যালয়ের ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অপরপ্রান্ত থেকে লাইন কেটে দেওয়া হয়। শেষমেষ প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ডিপার্টমেন্ট ওলিউর রহমানের মোবাইলে কল করলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর মোটরসাইকেলে আছেন জানিয়ে বলেন, ‘পরে কথা হবে’। তারপরই কল কেটে দেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখার উপ-প্রধান শেখ বদিউল আলমের ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও কল রিসিভ হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, সব আমদানিকারকের এলসি ঋণপত্র সঠিক এবং চূড়ান্ত কি-না যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিনো হয়েছে। এখানে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ নেই।
এ ধরনের এলসি ঋণপত্রের পূর্ব অভিজ্ঞতায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোপূর্বে বিদেশ থেকে গম আমদানির সময় শত শত কোটি টাকা গায়েব করেছে প্রভাবশালী চক্র। সেসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যাংক ও মন্ত্রণালয়ের কারও যোগসাজশ না থাকলে এ ধরনের কেলেঙ্কারি কোনোভাবেই ঘটা সম্ভব হতো না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৯
ইউজি/এইচএ/