দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মাঠে পৃথক গোয়েন্দা বাহিনী নামানোর পরিকল্পনা করছেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম।
২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশন গঠিত হয়।
সম্প্রতি ইস্কাটন গার্ডেন রমনায় বোরাক টাওয়ারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের অফিসে বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন কমিশনের চেয়ারপারসন মফিজুল ইসলাম। এছাড়াও কথা হয়েছে নানা বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মফিজুল সাদিক।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন নিয়ে কী ধরনের পরিকল্পনা আছে?
মফিজুল ইসলাম: ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা কমিশনের আইন হয়েছে। আমরা আইনের আলোকে কাজ করছি। আমরা বাজারে মুক্ত প্রতিযোগিতা চাই। বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চাই না। অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকলে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মুক্ত বাজার প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে আমাদের একটা গোয়েন্দা ইউনিট দরকার হবে। আমরা এই বিষয়ে একটা প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছি। সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে গোয়েন্দা ইউনিট মাঠে নামাতে চাই। তারা মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জন্য বাজারে কেউ বাধা সৃষ্টি করছি না। বিষয়টি সরেজমিনে দেখবে গোয়েন্দা ইউনিট। আমরা একটা প্রবিধান তৈরি করছি, প্রবিধানে সব লেখা থাকবে গোয়েন্দা ইউনিট কীভাবে কাজ করবে। আমি কমিশনে এসেই গোয়েন্দা ইউনিটের বিষয়টি চিন্তা করেছি। আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠাবো। এরপরই সরাসরি প্রতিষ্ঠানের জন্য গোয়েন্দা ইউনিট নিয়োগ করবো। প্রস্তাব আকারে অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো, এই বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমি মনে করি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও আরও কার্যকরী করতে একটা গোয়েন্দা ইউনিট থাকা দরকার। তার আগে আমাদের আরও কিছু কাজ করতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠান নতুন। এখানে নিজস্ব জনবল নেই। অনেকে প্রেষণে অথবা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করছেন। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বর্তমান সরকারের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে। আমার বিশ্বাস জনগণবান্ধব বর্তমান সরকার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উন্নয়নে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে ক্রেতা কীভাবে লাভবান হবেন?
মফিজুল ইসলাম: বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে সরাসরি ক্রেতা লাভবান হবে না। তবে আমাদের নেওয়া পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রেতারা পরোক্ষভাবে লাভবান হবেন। আমরা মনে করি, মুক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়া বাজারে কেউ টিকতে পারবে না। তবে পণ্যের মান বাড়াতে হবে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ধারাবাহিকতায় উৎপাদক, আমদানিকারক ও ক্রেতা-বিক্রেতার সমন্বয়ে বাজার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। তাত্ত্বিকভাবে চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতেই কোনো নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার সরবরাহকারী ও ভোক্তাদের আচরণ নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় ক্ষেত্রেই কোনো পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত আচরণ পরিলক্ষিত হয় না। এতে অনুমিত হয় পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডার ও প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের অভাব রয়েছে।
বাংলানিউজ: হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ?
মফিজুল ইসলাম: বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য প্রতি মেট্রিক টনে ৮৫০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ। এরপর থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মাধ্যমে প্রথমে চাল এরপরে পেঁয়াজ নিয়ে গবেষণা করিয়েছি। গবেষণা দুটি হাতে এসেছে। পরে একই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে গবেষণা অনুযায়ী কাজ করবো। সাপ্লাই চেইনের অভাব ছিল। দেশে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ মজুদ ছিল। এগুলো ২৫ থেকে ৩০ টাকায় কেনা ছিল। এই পেঁয়াজ দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ দিন ভালোই চলতো। তারপরও অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটি নিয়েছে। আমরা সবার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারসাজি করে যদি কেউ দাম বাড়ায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ৪৫ টাকা দরে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছি। কিছুটা হলেও অনেকে স্বস্তি পাচ্ছেন। বাজারে কম আয়ের মানুষ লাভবান হচ্ছেন। এটা ভালো উদ্যোগ বলে আমি মনে করি।
বাংলানিউজ: ক্রেতাদের আস্থার জায়গা তৈরি করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে কমিশন?
মফিজুল ইসলাম: যদি বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে তবে পণ্যের মান ও মূল্য ঠিক থাকবে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যেন কেউ একচেটিয়া ব্যবসা না করতে পারে। যোগসাজশ করে পণ্যের দাম যেন না বাড়িয়ে দিতে পারে। কেউ সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। বাজারে কারও হয়তো বড় ধরনের কর্তৃত্ব আছে, এটার নেতিবাচক প্রভাব খাটাতে দেওয়া হবে না। কেউ বাজার অস্থির করতে চাইলে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। বাজার যদি স্থিতিশীল করতে পারি অথবা প্রতিযোগিতা বিরোধী কাজ বন্ধ করতে পারি তবে ক্রেতাদের আস্থার জায়গা তৈরি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বাংলানিউজ: বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মফিজুল ইসলাম: এখনো আমাদের নিজস্ব জনবল কিন্তু একজনও নেই। এখানে ১০ থেকে ১২ জন অফিসার আছে যারা প্রেষণে কাজ করছে। তবে আমি নিয়োগপ্রাপ্ত। অন্য স্টাফরা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে। ৩০ থেকে ৩৪ জনের জনবল নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। তাদের নিয়োগ হয়ে গেলে আমাদের নিজস্ব জনবল হবে। ভবিষ্যৎ হয়তো কাজের ধরন অনুযায়ী আমাদের আরও জনবলের প্রয়োজন হবে। একটা গোয়েন্দা ইউনিট হয়তো প্রয়োজন হবে, সেইভাবে আমরা জনবল নিয়োগ করার চেষ্টা করছি। এছাড়া কমিশনের জন্য ৪ জন মেম্বার প্রয়োজন। সেখানেও আমাদের ঘাটতি আছে। যখনই আমরা এসব পেয়ে যাবো, আমরা পুরোদমে কাজ করতে পারবো।
বাংলানিউজ: বাজারের ম্যানুপুলেশন বন্ধে আপনার পরামর্শ কী?
মফিজুল ইসলাম: প্রথমেই বলবো, আমাদের নৈতিকতার জায়গা তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়ীরা অবশ্যই লাভ করবে কিন্তু সেটা যেন অস্বাভাবিকভাবে না হয়। মানুষকে কষ্ট দিয়ে যেন মুনাফা না করে এইটা আমাদের প্রত্যাশা থাকবে। সরকার ব্যবসায়ীদের নানাভাবে সাহায্য করছে। যেমন- পেয়াঁজ আমদানিতে ট্যাক্স ফ্রি করেছে সরকার।
বাংলানিউজ: প্রতিযোগিতা কমিশনের অর্জন কী?
মফিজুল ইসলাম: প্রতিযোগিতা কমিশন কাজ করছে বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য। ১ বছর আগে আমরা বিআইডিএসকে দিয়ে পেয়াঁজ ও চালের উপর স্টাডি করিয়েছি। তার মানে বলা যায়, আমরা অনেক আগে থেকেই বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। সেখানে বিআইডিএস আমাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যারা যারা কনসার্ন যেমন বাণিজ্য, কৃষি মন্ত্রণালয় ও অন্য সংস্থা তাদের এগুলো পাঠিয়েছি।
বাংলানিউজ: বাংলানিউজ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। নতুন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ভবিষ্যতে আরও সফলতা অর্জন করুক।
মফিজুল ইসলাম: বাংলানিউজ পরিবার ও এর পাঠকদেরও ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উন্নয়নে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৯
এমআইএস/এইচএডি/