চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে গত ৪ বছর ধরে কৃষি উপকরণ ও এর টাকাসহ আরও একটি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। আর এসব ফিরে পেতে প্রশাসনের কাছে তদন্তের অভিযোগ দায়ের হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি আজও।
ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মোবারকপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০ জন কৃষকের কৃষি উপকরণ দেওয়ার কার্ড কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও টাকা দেওয়ার নাম করে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের নির্দেশে হাতিয়ে নেয় ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ ইউসুফ আলী। বারবার সেসব কার্ড ফেরত চাইতে গেলে তাদের জানানো হয়, কৃষি উপকরণের বরাদ্দ এলে তাদের কার্ডে বরাদ্দ লিখে ফেরত দেওয়া হবে। দেওয়া হবে টাকা ও উপকরণ। কিন্তু কৃষকদের কার্ডগুলো অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ওই ইউনিয়নের অন্তত ৩০ জন কৃষককে কার্ড ফেরত না দিয়ে কার্ডে বরাদ্দ দেওয়া হয় বীজ, সার ও টাকা। দীর্ঘ ৪ বছর এভাবেই ওইসব কৃষকের প্রণোদনার উপকরণ ও টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কৃষকদের।
লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক মঈন উদ্দিনের কার্ড থেকে দেখা যায়, তার কার্ডে ২০১৮ এবং ২০ সালে ৩ দফায় ৩৫ কেজি বীজ, ২০ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি ডিএপি ৩৫ কেজি এমওপি সার এবং ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তিনি তা পাননি বলে দাবি করেন মঈন।
একইভাবে মোবারকপুরের শরিফ আলীর দাবি, তার নামে ২০১৮ ও ২০ সালে ৪ দফায় ৬০ কেজি বীজ, ২০ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি ডিএপি, ৩৫ কেজি এমওপি ও ৫০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও তিনিও তা পাননি। একই অবস্থা ওই ইউনিয়নের অন্তত ৩০ জন কৃষকের।
এ ব্যাপারে কৃষক লাল মোহাম্মদ ও নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, তারা তাদের কার্ড তৈরির পর ফেরত চাওয়ার জন্য একাধিকবার মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম মিঞা ও গ্রাম পুলিশ ইউসুফের কাছে গেলেও তারা তা কর্ণপাত করেনি। উল্টো তাদের নামে কোনো বরাদ্দ আসেনি বলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের নামে ২০১৮ সালে বরাদ্দ ৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে পাওয়া কথা থাকলেও ইউসুফ তার অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সব টাকা তুলে নিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান তার নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে ব্যাংকে কোনো ধরনের স্বাক্ষর বা টিপসই না দিলেও তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন বলে দাবি ভুক্তভোগী কৃষকদের। তাদের দাবি গত ৪ বছরে সরকারি কোনো প্রণোদনাই পাননি তারা।
অপরদিকে, গত ঈদুল ফিতরের সময় সরকারি প্রণোদনা হিসাবে ভিজিএফ বাবদ ৪৫০ টাকা করে ১ হাজার দরিদ্রের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ উঠেছে একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম মিঞার বিরুদ্ধে।
৯৭২ নম্বরে নাম থাকা সুমন আলী নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, তিনি ঈদের সময়ে ভিজিএফের কোনো টাকা পাননি। এছাড়াও কৃষক আলম ও গৃহিণী মিনিয়ারা বেগমের অভিযোগ তারাও ঈদের সময়ে কোনো সরকারি প্রণোদনার টাকা পাননি।
এ ব্যাপারে একই এলাকার শ্রমিক লীগের নেতা সবুজ আলী বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দেখিয়ে জানান, তাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান মিঞা গ্রাম পুলিশ ইউসুফের মাধ্যমে এলাকার ২ হাজার ৮৫ জনের মধ্যে ১ হাজার লোকের ভিজিএফের টাকা এবং এরাই একে অপরের যোগসাজস করে এলাকার ৫০ জন কৃষকের টাকা ও কৃষি উপকরণ ৪ বছর ধরে আত্মসাত করে আসছে। এনিয়ে তিনিসহ সচেতনমহল প্রতিবাদ করায় তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি চলতি বছরের মে মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর অভিযোগ দিলেও সে অভিযোগের এখনও তদন্ত শুরু হয়নি।
অন্যদিকে, অভিযুক্ত গ্রাম পুলিশ ইউসুফ দাবি করে বাংলানিউজকে বলেন, আমি কোনো কৃষকের কৃষি কার্ড নেইনি বা চেয়ারম্যানের নির্দেশেও কোনো অনিয়ম বা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেনি। যার যা প্রাপ্ত, তা সংশ্লিষ্ট কৃষক বুঝে পেয়েছেন।
অপরদিকে, অভিযুক্ত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান মিঞা বাংলানিউজকে বলেন, আল্লাহর রহমতে আমি ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, আধামণ সার, বীজ বা ৫০০ টাকা মেরে আমি লাভবান হবো না। কার কার্ড, কোথায় আছে? আমি নিজেও কিন্তু জানি না। প্রথমবার (২০১০ সাল) আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে ওই সময়ের মেম্বাররা কার্ড তুলে সবাইকে দিতেন। এরা তুলেছে, কী করেছেন তা জানি না। কয়েকদিন আগে আমি বিষয়টি জেনে অফিসকে বলেছি— কার কার কার্ড আপনারা তাদের ডেকে দিয়ে দিয়েন। এসব বিষয় ইউনিয়নের সচিব ও গ্রাম পুলিশরা তদারকি করেন।
দাখিলকৃত অভিযোগ প্রসঙ্গে তার দাবি, অভিযোগকারী একজন অসৎলোক। এর আগে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি ভেজাল করে মামলা করে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করেছেন। তিনি ২ লাখ টাকা উৎকোচও নিয়েছেন, যা তিনি মোবাইলফোনে বিস্তারিত না বলে বিস্তারিত জানতে তার দপ্তরে এ প্রতিবেদককে চা খাওয়ার দাওয়াত দেন।
আর বর্তমান অগ্রণী ব্যাংক মোবারকপুর শাখার ব্যবস্থাপক আহসান হাবিব বাংলানিউজকে বলেন, এটা অন্য ব্যবস্থাপকের সময়ের ঘটনা। এ ধরনের বিষয় শুনেছি যে গ্রাম পুলিশ না-কি কৃষকের টাকা এখান থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তবে ব্যাংকে টাকা তোলার সময় টিপসই সংরক্ষিত আছে। টিপসইগুলো কার এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ডিসি মুঞ্জুরুল হাফিজ বাংলানিউজকে বলেন, আমি বিষয়টি জানতাম না। তবে মাত্র জানলাম। দ্রুত বিষয়টি তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৮ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০২১
এসআরএস