বগুড়া: চলতি রবি মৌসুমে বগুড়ার চাষিরা মরিচ চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন। জেলার ১২টি উপজেলায় প্রায় ৭০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার শুকনো মরিচ উৎপাদন হয়েছে।
রোববার (১ আগস্ট) জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বগুড়ার লাল টুকটুকে মরিচের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। জেলার তিনটি উপজেলায় (সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট) বেশি মরিচ উৎপাদন হয়ে থাকে। এ উপজেলা তিনটি যমুনা নদী বেষ্টিত। এরমধ্যে সারিয়াকান্দির প্রায় সাতটি, সোনাতলার তিনটি ও ধুনটের একটি ইউনিয়ন পুরোপুরি যমুনায় ঘেরা। এসব ইউনিয়নের বেশির ভাগ চাষি বছরের এক মৌসুমে শুধু মরিচ চাষ করেন।
বগুড়ায় যমুনার পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষা করেন চরাঞ্চলের মরিচ চাষিরা। যমুনার বুক খালি হলেই যেন কপাল খুলে যায় নদী ভাঙনের শিকার হওয়া মানুষগুলোর। পানি নেমে যাওয়া মাত্র চরের উর্বর মাটিতে পা ফেলেন তারা। তোড়জোড় শুরু করেন মরিচ চাষে।
সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার লিয়াকত আলী, বেল্লাল হোসেন, সামাদ মিয়া, জুয়েলসহ একাধিক চাষি বাংলানিউজকে জানান, প্রতিবছর টানা তিন থেকে চার মাস চরাঞ্চলের চাষিরা মরিচ চাষে ব্যস্ত সময় পার করেন। উর্বর মাটির কারণে চরের জমিতে মরিচের ফলন ভালো হয়। চরের মরিচ গুণে-মানে ও স্বাদে অতুলনীয়। সারাদেশে চরের মরিচের আলাদা চাহিদা রয়েছে।
তারা জানান, মরিচ চাষে বেশি ব্যয় হয় শ্রমিকের মজুরি ও কীটনাশকে। মরিচ গাছগুলো ঠিক রাখতে প্রায় প্রতিদিন নিয়মানুযায়ী ওষুধ স্প্রে করতে হয়। সর্বোপরি ক্ষেতের গাছগুলোর ঠিকভাবে দেখভাল করতে হয়।
সারিয়াকান্দি উপজেলার চাষি খয়বর মণ্ডল বাংলানিউজকে জানান, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে তিনি যমুনার বুকে মরিচ চাষ করেন। চলতি রবি মৌসুমে মরিচের বাম্পার ফলনে তিনিসহ অন্যান্য চাষিরা লাভবান হয়েছেন। গত রবি মৌসুমে তিনি সাত বিঘা জমিতে ‘খ্যাতির মরিচ’ লাগিয়েছিলেন। বীজ, সার, সেচ, শ্রমিকের মজুরিসহ সব মিলে তার বিঘা প্রতি খরচ হয়েছিল ২৭ থেকে ৩২ হাজার টাকার মতো। শুকনো মরিচ হিসেবে প্রতিবিঘায় ফলন হয়েছিল অন্তত আট থকে নয় মণ।
তিনি আরও জানান, বগুড়ায় উৎপাদিত মরিচ দেশের নামিদামি অনেক কোম্পানি বা বড় বড় প্রতিষ্ঠান কিনে থাকে। প্রত্যেক বছর চাষিরা সুযোগটি কাজে লাগান। এ কাজে বাড়ির নারীরাও সমানভাবে সংযুক্ত থাকে। মরিচ লাগানো, উঠানো, শুকানো ও বস্তায় ভরা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পুরুষকে সহযোগিতা করেন নারীরা। বাড়তি আয়ের আশায় সবাই একযোগে মরিচের ক্ষেতে ব্যস্ত থাকেন।
গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার মরিচের দাম তুলনামূলক বেশি ছিল বলেও মন্তব্য করেন খায়বর মণ্ডল।
তিনি জানান, প্রথমে জমিতে চাষ দিতে হয়। এরপর রোপণ করতে হয় মরিচের বীজ। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতার সঙ্গে নিড়ানি, সামান্য সেচ ও সার দিতে হয় মরিচের ক্ষেতে। মূলত পরিচর্যা করাটাই আসল কাজ। মোটামুটি দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর ক্ষেত থেকে মরিচ উঠানো যায়।
শাজাহানপুর উপজেলার চাষি জাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, স্বল্প ব্যয়ে অধিক লাভের আশায় প্রায় ছয় বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছেন। বিজলী জাতের এ মরিচ চাষে প্রতিবিঘায় তার ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। চারা লাগানোর ৫০ থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে ক্ষেত থেকে মরিচ উঠানো শুরু হয়। ১৫ দিন পরপর মরিচ উঠানো যায়। কোনো কোনো সময় ১০ দিন পরও উঠানো যায় ক্ষেতের মরিচ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বগুড়ায় গত রবি মৌসুমে ১২টি উপজেলায় সাত হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ হয়। এরমধ্যে সিংহভাগ মরিচ চাষ হয় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায়। শুকনো মরিচ হিসেবে প্রতি হেক্টরে ফলন হয় দুই দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন হারে। এ হিসেবে গত মৌসুমে বগুড়ায় মরিচ উৎপাদন হয় ১৭ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৭০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, প্রতি বছর রবি মৌসুমে মরিচের চাষাবাদ হয়ে থাকে সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত। এ জেলার কৃষকরা জমিতে স্থানীয় ও হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করে থাকেন। সাধারণত মরিচ লাগানোর ৫৫ থেকে ৭০ দিনের মাথায় চাষিরা তা উঠানো শুরু করেন। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে প্রায় তিনমাস একটানা মরিচ উঠানো হয়। গুণগত মান ভালো বলেই দেশব্যাপী এ জেলার মরিচের সুনাম রয়েছে।
জেলায় চলতি খরিপ-১ মৌসুমে প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে মরিচ লাগানো হয়েছে। মার্চের শেষদিক থেকে জুন পর্যন্ত চাষিরা এ মৌসুমের মরিচ চাষ করেন। কাঁচা হিসেবে আট দশমিক পাঁচ মেট্রিক টন হারে প্রতি হেক্টর ফলন হচ্ছে। সে হিসেবে বর্তমান খরিপ মৌসুমে প্রায় ছয় হাজার ৮০০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচের ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২১
কেইউএ/এনএস