ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

খেজুরে লোকসান, মিশ্র ফলের বাগানে সফলতা সাইফুলের

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২২
খেজুরে লোকসান, মিশ্র ফলের বাগানে সফলতা সাইফুলের

লক্ষ্মীপুর: সৌদি প্রবাসী সাইফুল ইসলাম দেশের মাটিতে বিদেশি ফল চাষ করার স্বপ্ন নিয়ে দেশে আসেন। প্রথমে দুই হাজার দুইশ’ সৌদির খেজুরের চারা রোপণ করেন তিনি।

কিন্তু মাটির গুণাগুণ ভালো না হওয়ায় একটি বাদে তার বাগানের সব চারা মারা যায়। এতে প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো লোকসানে পড়তে হয়েছে তাকে। পরে খেজুরের চাষ বাদ দিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ করতে শুরু করেন সাইফুল। তিন বছরের মাথায় সফলতাও পেয়েছেন তাতে।  

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার শাকচর গ্রামে আড়াই একর জমিতে সমন্বিত ফলের বাগান করেছেন তিনি। বাগানের নাম সৈয়দ অ্যাগ্রো ফার্ম। বাগানটিতে থাকা প্রায় প্রত্যেক গাছের ডালে ঝুলছে নানা জাতের ফল। তার বাগানে বিদেশি জাতের বারোমাসি আম, ড্রাগন, বিভিন্ন প্রজাতির মালটা ও কমলা, পেয়ারা, পেঁপে, বরই, তিন ফলসহ নানা ধরনের ফল রয়েছে। এছাড়া বাগানের চারপাশে লাগিয়েছেন নারিকেল এবং সুপারি গাছ। বাগানের মাঝে মাঝে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করছেন উন্নত জাতের টমেটো, করলাসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। পুকুরে মাছ চাষ করছেন, সেই সঙ্গে আছে উন্নত জাতের গরুর খামার।  

সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমে খেজুর বাগান করে প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো লোকসানে পড়েছি। গাছের চারা রোপণ থেকে শুরু করে দীর্ঘ ছয় বছর সেগুলো পরিচর্যা করি। যে জমিতে বাগানটি করা হয়, সেটি বালু দিয়ে ভরাট করা ছিল, এছাড়া পাশেই ছিল একটি ইটভাটা। ছয় বছরের মধ্যে একটি ছাড়া সব গাছ মরে যায়। পরে সমন্বিত ফলের চাষাবাদ শুরু করি। তবে চারা লাগানোর স্থান থেকে বালু সরিয়ে মাটি এবং জৈব সার ব্যবহার করি। এতে ব্যাপক সফলতা এসেছে।  

তিনি বলেন, ২০১৯ সাল থেকে সমন্বিত বাগান তৈরির কাজ শুরু করি। তখনও আমি সৌদি প্রবাসী ছিলাম। ছুটিতে দেশে এসে বাগানে আম, ড্রাগন, মালটা, পেয়ারা পেঁপে ও কমলার চারা রোপণ করি। বাগানের অবস্থা ভালো দেখে ২০২১ সালে সৌদি আরব থেকে একেবারেই দেশে চলে এসে বাগানের হাল ধরি। বাণিজ্যিকভাবে বাগানটি সাজাতে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। দুই বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন গাছে ফল ধরতে শুরু করে। আর তিন বছরের মাথায় এখন পুরোদমে ফল দিচ্ছে গাছগুলো। চলতি মৌসুমে প্রচুর মালটা, পেঁপে, ড্রাগন, পেয়ারা, ডাব বিক্রি করেছি। এছাড়া প্রায় চার মণ বারোমাসি আম, দেড় মণ ছোট কমলা (মেন্ডারিনা), দুই থেকে আড়াই মণ বড় জাতের কমলা, সাত-আট কেজি তিন ফল বিক্রি করেছি।  

সাইফুল বলেন, বাগানে যেসব ফল গাছ রয়েছে, সবই উন্নত জাতের। সৌদি আরবসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চারা সংগ্রহ করেছি। চারার গুণাগুণ, মাটির গুণাবলি এবং সঠিক পরিচর্যা পেলে বাগানে সফলতা আসে। তিন বছরের মাথায় আমি সফল হয়েছি। প্রতি মাসে খরচ বাদ দিলে বাগান থেকে লাখ টাকা আয় হচ্ছে। আগামী মৌসুমে যা আরও বাড়বে বলে আশা করছি।

সাইফুলের বাগানে এখন ৪ প্রজাতির ২২৫ টি আম গাছ রয়েছে। এর মধ্য কাটিমন জাতের ৭০ টি, গোলমতি ৬০ টি, বারি ফোর ৬০ টি, বেনানা জাতের ৩৫টি। এক বছর পর থেকে গাছে ফলন আসে। গত তিন বছর থেকে কাটিমন জাতের আম গাছ থেকে তিনি ফল পাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে ৪ মন আম বিক্রি করেছে। প্রতিকেজি আমের মূল্য পেয়েছেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।  

সাইফুল বলেন, কাটিমন নামে বিদেশি এক প্রজাতির আম সারা বছর থাকে। তবে আমের মৌসুমে আম বেশি ধরে। এ জাতের গাছগুলোতে এখন আম এবং মুকুল দুটোই রয়েছে।  

সাইফুলের বাগানে বর্তমান সময়ের লাভজনক এবং জনপ্রিয় ফল মালটার ফলন হয়েছে ব্যাপক হারে। চার জাতের ২৫৫টি মালটা গাছ রয়েছে তার বাগানে। এর মধ্যে দেশি বারি-১ জাতের ১৫০টি, ক্যালিফোর্নিয়া ৭০টি, ডোরাকাটা মালটা ১৫টি, মিশরীয় মালটা ২০টি গাছ রয়েছে। চলতি মৌসুমে দেশি বারি এবং ডোরাকাটা ১২০টি গাছে ফলন হয়েছে আশানুরূপ। এক টনের মতো মালটা সংগ্রহ করতে পারবেন তিনি।  

সাইফুলের বাগানে থাকা ৬০টি ছোট জাতের কমলা (মেন্ডারিনা) গাছ রয়েছে। প্রতি গাছে ৭০ থেকে ৮০ কেজি কমলা আছে। দার্জিলিং জাতের বড় কমলা গাছ আছে ২০০টি। ১০টি গাছ ফল দিতে শুরু করেছে। সিজনে ৭০ থেকে ১০০ কেজি ফল আসে প্রতি গাছে।  

বাগানে থাকা বিভিন্ন গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয়েছে দেশি এবং টপলেডি জাতের পেঁপে গাছ। পাঁচ মাস পর থেকেই গাছগুলোতে ফল ধরবে। গাছ প্রতি বছরে ২০ থেকে ৩০ কেজি পেঁপে পাচ্ছেন তিনি।  

সাইফুল জানান, সবচেয়ে বেশি লাভজনক ফল ড্রাগন। শুধু লাগানোর সময় সার এবং আনুষঙ্গিক খরচ পড়ে। এক বছর পর ফল ধরতে শুরু করে। তিন বছর পর মৌসুমে টানা সাত-আট মাস ফলন দেয়। তার বাগানে ৩১টি পিলারে পাঁচটি করে গাছ রয়েছে। প্রতি পিলার থেকে এ মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে ড্রাগন পেয়েছেন। তার বাগানে ড্রাগনের আকার বড় এবং খেতে সুস্বাদু বলে জানান তিনি।  

সাইফুলের বাগানে ২০০টি দেশি জাতের পেয়ারা গাছ রয়েছে। প্রতি গাছে বছরে ৩০ থেক ৪০ কেজি ফল পাওয়া যায়। আপেল কুল (বরই) গাছ রয়েছে ৩৫টি। তিন বছর আগে গাছগুলো লাগিয়েছেন তিনি। দুই বছর পর থেকে ফল দিচ্ছে। মৌসুমে প্রতি গাছে ৪০ থেকে ৭০ কেজি ফল মিলছে।
 
সাইফুল বলেন, পুরো বাগানটি আমি নিজেই পরিচর্যা করি। কখন কোন ধরনের ওষুধ এবং সার দিতে হবে, সে বিষয়টি শিখেছি। ইউটিউব এবং বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক প্রতিবেদন দেখে উসাহিত হই। বাগান তৈরিতে কৃষি বিভাগেরও পরামর্শ নিয়েছি।  

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও আমি ফলের চারা সংগ্রহ করেছি। কিন্তু এখন আমি নিজেই চারা (কলম) তৈরি করি। যে কেউ চাইলে আমার এখান থেকে উন্নত জাতের কলম সংগ্রহ করে বাগান তৈরি করতে পারে। এজন্য সব পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।  

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সাইফুলের সমন্বিত ফলের বাগানটি পরিদর্শন করে আমাদের মাঠকর্মীরা তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।