চট্টগ্রাম: ঋণ, বিশৃঙ্খলাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে স্বনির্ভর করবেন জানিয়ে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই। আমি অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের ৪১ ওয়ার্ডে প্রোগ্রাম দেব।
এ জন্য গণসচেতনতা বাড়াতে হবে।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) লালদীঘির পাড়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
নানা সমস্যায় জর্জরিত চসিককে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে মেয়র বলেন, আজকের এই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রামে যেখানে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা ছিল, সেখানে হয়ে গেছে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার। আজ আমি যখন দায়িত্ব নিচ্ছি আমার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বলছেন যে, আমি প্রায় ৪৪০ কোটি টাকার একটি ঘাটতি ঋণের বোঝা নিয়ে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি। আমাকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কাজ করতে হবে।
আমি একসময় চট্টগ্রামের রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান ছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানে যখন আমি দায়িত্ব নিই সেসময় ছোট এই প্রতিষ্ঠানটি ঋণে জর্জরিত ছিল। আমি যখন বেরিয়ে আসি তখন প্রায় ৪ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রেখে এসেছি এবং একটি নতুন ভবন তৈরি করে দিয়েছি। কাজেই আমি আপনাদের আশা দিতে চাই আপনারা অত্যন্ত সততার সঙ্গে দুর্নীতি মুক্তভাবে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আমার সাথে কাজ করবেন, আপনাদের সব চ্যালেঞ্জ আমি নিলাম। এই সিটি করপোরেশন একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি আপনাদের উপহার দেব ইনশাআল্লাহ।
মেয়র বলেন, চট্টগ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। এই চট্টগ্রাম শুধু আমার একার নয়; এই চট্টগ্রাম আমাদের সবার। এই স্লোগান দিয়ে আমি আমার কার্যক্রম শুরু করব। আমাদের চট্টগ্রামের প্রতি মমত্ববোধ ভালোবাসা থাকতে হবে। তখনই আমরা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলদি সিটি উপহার দিতে পারব। যেটি আমার নির্বাচনী ইশতেহারে আপনারা দেখেছেন।
তিনি বলেন, আমি নিজেই স্পটে যাব। আমি কিন্তু সকালে এখানে বেশিক্ষণ থাকবো না। দুুই থেকে তিন ঘণ্টা অফিসে থাকবো। এরপর আমি বেরিয়ে যাবো একদিন এক-এক ওয়ার্ডে পরিদর্শন করবো। আমার সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানের লোকজন এবং ডেঙ্গু সেল নিয়ে যারা কাজ করছেন তারাও থাকবেন। আমি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরবো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম নিজে দেখবো। একটু আগে শুনেছি পরিচ্ছন্ন বিভাগে প্রায় ২ হাজার কর্মচারী নিয়োজিত। আমি প্রতিটা ওয়ার্ডে গিয়ে সশরীরে তাদের দেখতে চাই। আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি যদি কাউকে আমি না দেখি তাদের চাকরি হয়তোবা নাও থাকতে পারে। আমাকে অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। কারণ আমি বারবার বলছি আমি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি রাজনীতিবিদ তবে সে রাজনীতি সিটি করপোরেশনের বাইরে। আমি আমার নেতাকর্মীদের এখানে অনেকেই আছে তাদের আমি বলতে চাই আপনারা আমাকে কাজের সময় ডিস্টার্ব করবেন না। আপনাদের সাথে আমি রাজনীতি করব সন্ধ্যা ৫টার পর। ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কোনো ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ আলাপ-আলোচনা নিয়ে আমার কাছে আসবেন না। আমি এটা স্পষ্ট করে বলছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয় একজন সদালাপী, অত্যন্ত কর্মঠ লোক। গত কয়েকদিন আমি মন্ত্রণালয়ে উনার সাথে সময় কাটিয়েছি যদিও সেখানে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থাকার কথা। ৮৫ বছরের বয়স্ক একজন লোক দিনরাত কষ্ট করে যাচ্ছেন এবং রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন। গতকালও রাত ৮টা পর্যন্ত আমাদের সাথে ডেঙ্গু নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন। কাজেই এত বয়সে যদি একজন লোক যদি কষ্ট করতে পারে আমরা কম বয়সে কেন কাজ করতে পারবো না!
তিনি বলেন, আমাদের কাজের প্রতি সিনসিয়ারিটি এবং কাজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। তাই আজকে আমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ওপর জোর দিতে চাই। প্রথমে একটা ক্লিন সিটিতে রূপান্তর করতে চাই। আমি বলতে চাই যে দোকান ও প্রতিষ্ঠানের সামনে ময়লা আবর্জনা পাওয়া যাবে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
তিনি চসিক কর্মকর্তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সমস্ত বিন রেডি করে রাখার নির্দেশনা দেন। দোকানদাররা দোকানের সামনে একটা একটা বিন বসিয়ে দেবেন। দোকানদাররা সেই বিনে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন। সবারই উচিত নিজের আঙিনাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। আপনার সামনের যে উঠান আছে সে উঠান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব আপনাদের। আর বাকিগুলো আমি করব কাজেই আপনাদের দোকানের সামনে যদি কোনো ময়লা পড়ে থাকে তাহলে আমি কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। আমার সাথে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানের কর্মীরা এবং যারা কর্মকর্তারা আছে আপনারা সবাই থাকবেন। আমি রাজনীতি করেই বড় হয়েছি। কোনো ভয়-ভীতি, ধমক এগুলো কেউ দিলে সেটা বোকার স্বর্গে বাস করবেন। কাজেই আমি সবাইকে বলছি যে প্লিজ দেশটাকে ভালোবাসুন। দেশের প্রতি মমত্ববোধ দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশের প্রতি যদি আপনার সততা না থাকে আপনি নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবেন না।
মেয়র বলেন, প্রথমে আমি নিজেকে দিয়ে সংস্কার করতে হবে। আমি নিজের আত্মশুদ্ধি দিয়ে আমাকে শুরু করতে হবে। তাহলে দেখবেন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমরা করতে পারি আমরা জানি আমরা আসলে বাঙালিরা কর্মঠ আমরা কাজ করতে জানি। আসলে হয়েছি কি আমরা একটা সিস্টেমের মধ্যে পড়ে গেছি। যার কারণে আমরা আজকে সেটা করতে পারছি না। আমি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করবো। ইতিমধ্যেই সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় করার জন্য গত ১৫-২০ দিন ঢাকাতে অবস্থান করেছি। আমি বেশ কয়েকটি টকশো করেছি এবং এসব মন্ত্রণালয়ের যারা উপদেষ্টা আছে তাদের কথা বলেছি যে এটার জন্য যে জিনিসটি খুবই দরকার সেটা হচ্ছে যে সিটি গভর্মেন্ট বা নগর সরকার। যদি সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে নগর সরকার হয় তাহলে সব সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হবে।
হোল্ডিং ট্যাক্স যদি আমরা ঠিকমত পাই ইনশাআল্লাহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বেতন দেওয়ার জন্য আর কোনো সমস্যা হবে না কিন্তু ওই হোল্ডিং ট্যাক্সও আমরা কিন্তু পাচ্ছি না। বিভিন্ন কারণে অনেকেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। নাগরিকরা আপিল করতে করতে সমাধান না পেয়ে অনেকেই ৩০-৪০ শতাংশ কর দিচ্ছেন। মাঝখানে একটা গ্রুপ সেখানে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে কমিয়ে দেওয়ার কথা বলে এদিক ওদিক করে টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। সিটি করপোরেশনকে আপনারা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যাবেন না। এ বিষয়টার সমাধান করতে হবে।
প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ করতে চান জানিয়ে মেয়র বলেন, শহরে খেলার মাঠ নেই। ফলে, একপর্যায়ে টার্ফ তৈরি হলো। আজকে যে টার্ফ তৈরি হয়েছে এটা সমাজের মধ্যে একটা বৈষম্য তৈরি করছে। গরিব বাচ্চারা কিন্তু সেখানে খেলতে পারছে না। এতে তাদের মনের মধ্যে যে সাইকোলজিকাল ডেমোরাইজ হয়ে যাচ্ছে এ কথাটা কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না। এই জিনিসগুলোর বিষয়ে কিন্তু আমাদের মানবিক হতে হবে। আমাদের এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমি অবশ্যই এদিক দিয়ে নজর দেব। আজকে আমরা এই ছোট্ট একটা মোবাইলের মধ্যে আমাদের চোখ চলে গেছে। সারাক্ষণ সেখানে আমরা দুই চোখ দিয়ে রাখছি। এটার কারণে আমাদের চোখ-কান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নার্ভের সমস্যা হচ্ছে, বাচ্চাগুলো এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। সোসাইটির সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। আমার মনে হয় ভেরি ইম্পর্টেন্ট প্রতিটা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একটা একটা খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে।
চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগকে ঢেলে সাজানো হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, একসময় দেখতাম যে মেমন হাসপাতালে প্রচুর রোগী চাইল্ড অ্যান্ড ম্যাটারনাল ফ্যাসিলিটিসের জন্য আসত। এটা চট্টগ্রামে এক নাম্বার ছিল। আমি ওই এক নাম্বার জায়গায় মেমন হসপিটালকে নিতে চাই এবং ৪১ ওয়ার্ডে যেসব ছোট ছোট হেলথ রিলেটেড সেন্টার আছে, ডিসপেন্সারি; এগুলো আরো অ্যাকটিভ করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে একটা ছোট্ট অপারেশন থিয়েটার করে দিয়ে, ছোট ছোট যে সার্জারিগুলো যাতে হয় সেগুলো আমরা সেখানে করতে পারি। আমি বলছি আমি যাব, আমি হাঁটবো কোনো সমস্যা নাই। আমি সময় দিব। সিটি করপোরেশনকে আমি একটা পরিবর্তনের জায়গায় নিয়ে আসতে চাই।
শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে মেয়র বলেন, আপনারা জানেন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের টাকা দিয়ে করা। আজকে সেটা দখল হয়ে গেছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উদ্ধার করব ইনশাল্লাহ। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি সেটা আমি করব।
মেয়রের সাথে দিনব্যাপী কার্যক্রমে ছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, সচিব মো. আশরাফুল আমিন, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমি, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেম, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরী, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. ইমাম হোসেন রানা প্রমুখ।
দুপুরে মেয়র হজরত শাহ্ আমানত (র.) মাজার জেয়ারত করেন এবং গরিব-দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করেন। বিকেলে লালদীঘি পাড়ে চসিক লাইব্রেরি ভবনের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় করেন। সন্ধ্যায় টাইগারপাসস্থ নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে যোগ দেন। এরপর তিনি মেয়রের চেয়ারে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০২৪
এআর/টিসি