ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ পৌষ ১৪৩১, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮ রজব ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বড় জাহাজে সক্ষমতার নতুন দুয়ার খুললো বন্দরে

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০২৫
বড় জাহাজে সক্ষমতার নতুন দুয়ার খুললো বন্দরে ...

চট্টগ্রাম: শিপিং এজেন্টদের বড় জাহাজে বেশি পণ্য পরিবহনে উৎসাহ দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর ফলে আমদানি-রপ্তানিকারকদের সময়, খরচ, ঝুঁকি কমছে।

বন্দর চ্যানেল, জেটি, বার্থ, ইক্যুইপমেন্ট, ইয়ার্ডের সদ্ব্যবহার হচ্ছে। এককথায় নানাভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।
গতিশীল হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।  

চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন দেশের পতাকাবাহী ৯৮টি কনটেইনার জাহাজ চলাচলের অনুমতি আছে। আগে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টিইইউস (২০ ফুট দীর্ঘ) ধারণক্ষমতার জাহাজ বেশ ছিল। এখন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ কনটেইনার ধারণক্ষমতার জাহাজ আসছে অন্তত ১০টি। আড়াই হাজার টিইইউস ধারণক্ষমতার জাহাজও বন্দরে আসছে নিয়মিত।  

সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪ হাজার ১০৩টি জাহাজ ভিড়িয়ে যত কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে তার চেয়ে বেশি করেছে ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৮৬৭টি জাহাজের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে জাহাজ কম এসেছে ২৩৬টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এর প্রধান রহস্য বড় জাহাজ। ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৩ দশমিক ২৭ মিলিয়ন টিইইউস (২০ ফুট হিসেবে) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে। কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে ১২৩ মিলিয়ন মেট্রিকটন। ২০২৩ সালের তুলনায় কনটেইনারে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, কার্গোতে ৩ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বন্দরের একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, বড় বা ছোট সব জাহাজ বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদীর চ্যানেল দিয়ে চালিয়ে আনার জন্য বন্দরের অভিজ্ঞ পাইলট পাঠানো হয়। জাহাজটি নিরাপদে আনতে শক্তিশালী ২-৩টি টাগ বোটের সহায়তা দরকার হয়। এখন ছোট জাহাজ যদি বেশি আসে তাহলে বন্দরের বেশি পাইলট, বেশি টাগ, বেশি বার্থ লাগবে। তুলনামূলক বড় জাহাজ আসলে ট্রিপ কমে যাবে, পাইলট, টাগ, জেটিও কম লাগবে। পণ্যের ভাড়া, ডেমারেজ এগুলোও বড় জাহাজে সাশ্রয়ী হবে নিঃসন্দেহে।  

তিনি বলেন, বড় জাহাজ লাভজনক হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন বড় বড় জাহাজ কিনেছে। এগুলো কার্গো নিয়ে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ পাড়ি দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত তিনটি এখনো বাংলাদেশের জলসীমাতেই আসেনি।  

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বাংলানিউজকে বলেন, একটা সময় বন্দরে সর্বোচ্চ ১৮৬ মিটার লম্বা জাহাজ আনা যেত। পরে তা বাড়িয়ে ১৯০ মিটার এবং সর্বশেষ ২০০ মিটার করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাহাজের পানির নিচের অংশ বা ড্রাফটও বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে আগে ৪টি ছোট জাহাজে যে পণ্য বা কনটেইনার আনা হতো এখন তা ২-৩টি বড় জাহাজে আনা সম্ভব হচ্ছে। ফলে কস্ট মিনিমাইজ হচ্ছে। এর আর্থিক সুবিধা অনেক। ছোট জাহাজ বেশি আসলে জোয়ার-ভাটার অপেক্ষা, জেটি খালি না থাকাসহ নানা কারণে বহির্নোঙরে অপেক্ষা করতে হতো। এতে ডেমারেজ দিতে হতো শিপিং এজেন্টদের। এখন জাহাজের গড় অপেক্ষার সময় অনেক কমে এসেছে। বড় জাহাজের গড়নের ওপর নির্ভর করে পণ্য বা কার্গো ধারণক্ষমতা কম বেশি হয়। ড্রাফটও বড় ফ্যাক্টর।

তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ সক্ষমতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বড় জাহাজকে উৎসাহিত করা। ইতিমধ্যে অনেক বড় কনটেইনার জাহাজ আসা শুরু হয়েছে। নতুন নতুন রুট, নতুন নতুন জাহাজ সব ক্ষেত্রে বন্দরের প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে আশাকরি।  

সূত্র জানায়, ১৯৭৫ সালে বন্দরে ১৬০ মিটার লম্বা ও সাড়ে ৭ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো হতো। ১৯৮০ সালে তা বাড়িয়ে ১৭০ মিটার লম্বা ও ৮ মিটার ড্রাফট করা হয়। ১৯৯০ সালে ১৮০ মিটার লম্বা ও সাড়ে আট মিটার ড্রাফটে উন্নীত করা হয়। ১৯৯৫ সালে ১৮৬ মিটার লম্বা ও ৯ দশমিক ২ মিটার ড্রাফট করা হয়। ২০১৪ সালে ১৯০ মিটার লম্বা ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো শুরু হয়। ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বন্দরের মূল জেটিতে (সিসিটি) সফলভাবে মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী ২০০ মিটার লম্বা, ১০ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ ‘কমন অ্যাটলাস’ ভিড়ানো হয়।  

বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, বহির্নোঙরে জাহাজের গড় অপেক্ষার সময় ১ দিনে নেমে এসেছে। বন্দরে ভারী কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য লালদিয়া উত্তর এলাকায় একটি হেভি লিফট কার্গো জেটি নির্মাণের প্রকল্প চলমান আছে।  
 
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, বড় জাহাজে ধারণক্ষমতা ও দক্ষ জনবল বেশি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গিয়ারলেস ও গিয়ার ভ্যাসেলের সুন্দর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করছে। যেহেতু সিসিটি ও এনসিটিতে বিশ্বমানের কি গ্যান্ট্রি ক্রেন আছে সেহেতু গিয়ারলেস (ক্রেন ছাড়া) ভ্যাসেল সেখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যাতে কম সময়ে কনটেইনার লোড আনলোড করে জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতে পারে। এটি একটি বড় সিদ্ধান্ত। সবাই জানে গিয়ারলেস জাহাজে পণ্য বা কার্গো বেশি বহন করা যায়। কারণ ক্রেনের জায়গাতেও কার্গো রাখা হয়।  

বন্দর কর্তৃপক্ষ রপ্তানির কনটেইনার দ্রুত শিপমেন্টে সর্বোচ্চ সহায়তা দিচ্ছে পোশাক মালিকদের। কারণ একটি কনটেইনার জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগে রপ্তানি পণ্য ভর্তি কনটেইনার ও খালি কনটেইনার ব্যালেন্স করে জাহাজে তুলতে হয়। নয়তো ভারসাম্য নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা বা বিপদ ঘটতে পারে। তাই ক্যাপ্টেনকে পরিকল্পনা করে কোন স্লটে কোন ধরনের কনটেইনার তোলা হবে তা ঠিক করতে হয়। তারপরও বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতির নির্ধারিত সময়ের আগপর্যন্ত রপ্তানির কনটেইনার জাহাজে তুলে দিতে আন্তরিকভাবে কাজ করে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মেইন লাইন অপারেটররা একে অন্যের কনটেইনার পরিবহন করছে। এর ফলে যে জাহাজগুলো বন্দরে আসা-যাওয়া করছে সেগুলো ধারণক্ষমতার কাছাকাছি কনটেইনার বা কার্গো পরিবহন করতে পারছে।  

বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, কাস্টম হাউস, এনবিআর, শিপিং এজেন্ট, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বার্থ ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটর, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, বন্দর ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন সংগঠন, বন্দরের শ্রমিক-কর্মকর্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দর দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। বন্দরের সক্ষমতা, দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা উন্নততর হচ্ছে। তারই অন্যতম উদ্যোগ বড় জাহাজকে উৎসাহিত করা। এর সুফল এ বছর আমরা পেয়েছি- কম জাহাজ দিয়ে বেশি পণ্য বা কনটেইনার হ্যান্ডলিং।  

তিনি বলেন, বড় জাহাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি সব জাহাজে ফুল ক্যাপাসিটি লোড করার বিষয়টিও নজরদারি করা হচ্ছে। আগে দেখা যেত ২ হাজার টিইইউ’স কনটেইনার ধারণক্ষমতার একটি জাহাজ ৮০০ কনটেইনার নিয়ে বন্দর ছাড়ত। এখন সেটি কমে এসেছে। বড় জাহাজের সুফল পেতে বন্দরে কনটেইনার জট হতে দেওয়া যাবে না। বিশ্বের আধুনিক বন্দরগুলোর মতো চট্টগ্রাম বন্দরেও এফসিএল কনটেইনার ইয়ার্ডে খুলে ডেলিভারি দেওয়ার বদলে অফডকে নেওয়ার অনুমতি দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটি হলে বন্দরে প্রায় ১ মিলিয়ন কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়বে, সরকারের আয় বাড়বে ২ হাজার কোটি টাকা।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০২৫
এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।