ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

দুঃসময় পার করেছেন চট্টগ্রামের গণমাধ্যমকর্মীরা

নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
দুঃসময় পার করেছেন চট্টগ্রামের গণমাধ্যমকর্মীরা ফাইল ছবি।

চট্টগ্রাম: সাংবাদিক নির্যাতনের বেদনা ও চিরবিদায়ের শোক সহ্য করে ২০২০ সাল পার করেছেন চট্টগ্রামের গণমাধ্যমকর্মীরা। পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত হয়ে দুঃসময় পার করেছেন বেশ ক’জন সাংবাদিক।

‘আর নিউজ করবি কি না বল’? এ কথা বলতে বলতে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় আজকের সূর্যোদয় চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার গোলাম সরওয়ারের ওপর। গত ২৮ অক্টোবর চন্দনাইশের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নগরের ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার পর অপহরণের শিকার হন তিনি।

সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে ১ নভেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় খালের পাশে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া যায় গোলাম সরওয়ারকে। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় ৪ নভেম্বর কোতোয়ালী থানায় তিনি বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।

গোলাম সরওয়ার বাংলানিউজকে বলেন, একটি বাসায় নিয়ে চোখ বেঁধে আমাকে মারধর করা হয়। শরীরে কাপড় জাতীয় কিছু একটা মুড়িয়ে কাঠের তক্তা ও বেল্ট দিয়ে মারধর করা হয়েছিল। আমি এখনও সেই দুঃসহ নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে মামলা-হামলার ভয়ে দিন কাটাচ্ছি।

নগরের ফয়’স লেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৩ জানুয়ারি সকালে যমুনা টেলিভিশনের রিপোর্টার আসহাবুর রহমান শোয়েব ও ক্যামেরাপারসন সঞ্জয় মল্লিকের ওপর হামলা করেন কয়েকজন আনসার সদস্য। এ ঘটনায় তিন আনসার সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।  

৭ এপ্রিল দুপুরে কোতোয়ালী থানাধীন বক্সিরহাট এলাকায় ক্রেতার কাছে পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য দাবির প্রতিবাদ করায় হামলার শিকার হন সাংবাদিক মুহাম্মদ মহরম হোসাইন। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করে। ১৬ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে ফটিকছড়ির আজাদী বাজার থেকে মোটর সাইকেলে ধর্মপুর গ্রামে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন দৈনিক আজাদীর ফটিকছড়ি উপজেলা প্রতিনিধি এস এম আকাশ। মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে আহত করে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি তিনি।

২৪ আগস্ট সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের মানববন্ধন চলাকালে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৭ জন সাংবাদিক আহত হন। তারা হলেন-চ্যানেল আই চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান চৌধুরী ফরিদ, ক্যামেরাপার্সন নবাব মিয়া, চিত্র সাংবাদিক সাইদুল আজাদ, বাচ্চু বড়ুয়া, আকতার হোসেন, এম হায়দার আলী ও মো. জাহাঙ্গীর।

১৯ সেপ্টেম্বর হাটহাজারীতে হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফির জানাজায় সাংবাদিকদের নাজেহাল ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেন সাংবাদিক নেতারা। পরে সাংবাদিকদের পরিচয়পত্র উদ্ধার করে ফেরত দেওয়া হয়।

সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় আসামি পক্ষের লোকজন। এ সময় তারা সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। লাঞ্ছিত হন সময় টিভির সিনিয়র রিপোর্টার পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, যমুনা টিভির সিনিয়র রিপোর্টার হোসাইন জিয়াদ, ডিবিসি নিউজের শহীদুল সুমন, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ক্যামেরাপারসন আবু জাহেদ, দীপ্ত টিভির ক্যামেরাপারসন সায়মন আল মুরাদ, ডিবিসি নিউজের ক্যামেরাপারসন পারভেজ, একাত্তর টিভির ক্যামেরাপারসন জহির, সময় টিভির ক্যামেরাপারসন আতিকসহ আরও কয়েকজন।  

এছাড়া জেলা-উপজেলায় সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদ প্রকাশের জের ধরে অনেক গণমাধ্যমকর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। করোনাকালের অজুহাতে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে।

এদিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজ চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সমরেশ বৈদ্যের মা তৃপ্তি বৈদ্য (৭৫) পরলোকগমন করেন। ৯ মার্চ দৈনিক সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ কুতুব এর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল বাহার (৭৬) ইন্তেকাল করেন। ১০ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক সবুর শুভ’র পিতা হাজী আবদুর রাজ্জাক (৮৫) ইন্তেকাল করেন। ১৭ মার্চ বৈশাখী টেলিভিশনের ব্যুরো প্রধান মহসিন চৌধুরীর চাচি জাহেদা বেগম (৯০) ইন্তেকাল করেন।  

গত ৪ এপ্রিল সময় টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান কমল দে এর বড় ভাই সাবেক ক্রিকেটার স্বপন কুমার দে (৫৫) পরলোকগমন করেন। ৬ এপ্রিল ঢাকায় ইন্তেকাল করেন সাংবাদিক আলাউদ্দিন মজিদের স্ত্রী সিলভা মজিদ (৫৩)। ১১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় ইন্তেকাল করেন দৈনিক ইত্তেফাক চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সালাহউদ্দিন মো. রেজার মা আহসান আরা (৯০)। ২১ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ সম্পাদক সৈয়দ উমর ফারুকের ছোট ভাই সৈয়দ আহসান হাবীব (৫৮)। ১ মে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন সাংবাদিক আবু সুফিয়ানের ছোট ভাই মোহাম্মদ শাহাজাহান (৬০)। ৫ মে সকাল ৮টায় আসাদগঞ্জের বাসভবনে ইন্তেকাল করেন প্রবীণ সাংবাদিক খুরশীদ আলম বশীর।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম চট্টগ্রাম অফিসের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধরের মা লীলা রাণী ধর (৭৬) গত ৬ জুন চমেক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ৭ জুন রাতে সাংবাদিক চৌধুরী আহসান খুররমের পিতা শফিকুল আলম চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। ৯ জুন এশিয়ান টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন সুজন আচার্যের পিতা রনজিত আচার্য (৭০) মা ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১০ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জোবায়ের চৌধুরীর পিতা জসিম উদ্দিন চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। ১২ জুন দৈনিক আজাদীর সম্পাদনা সহকারী হাসান ফারুকীর স্ত্রী জোবায়দা কাউসার (৪০) করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৩ জুন দিবাগত রাত ৩টার দিকে ইন্তেকাল করেন এনটিভির ক্যামেরাপার্সন এনামুল হকের মাতা শামসুন নাহার। ১৯ জুন দৈনিক নয়াবাংলার সাংবাদিক আবুল কাসেম (৬৭) ইন্তেকাল করেন। ২৫ জুন সাংবাদিক খন্দকার আখতার আহমদ (৬৯) ইন্তেকাল করেন। দৈনিক পূর্বকোণের সহ সম্পাদক ফারমিনা তাসলিমের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বার ইন্তেকাল করেন ৩০ জুন।  

৬ জুলাই ইন্তেকাল করেন সাংবাদিক এজাজ মাহমুদের ছোট ভাই আশেক মাহমুদ। ২৪ আগস্ট সাংবাদিক ফারুক ইকবালের বড় ভাই রেজাউল করিম সেলিম (৬৬) ইন্তেকাল করেন। ২৬ আগস্ট কালের কণ্ঠের ফটিকছড়ি প্রতিনিধি আবু এখলাস ঝিনুকের মা নুর খাতুন (৮০) ইন্তেকাল করেন।

৫ সেপ্টেম্বর এনটিভি চট্টগ্রাম অফিসের স্টাফ ক্যামেরাপার্সন সুমন গোস্বামীর বাবা হরিপদ গোস্বামী (৭৫) পরলোকগমন করেন। ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন সাংবাদিক পার্থ প্রতীম নন্দীর বাবা কল্যাণ কান্তি বিশ্বাস (৭১)। ১৬ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠের ব্যুরো প্রধান মুস্তফা নঈমের মা খাদিজা আক্তার (৮১) ইন্তেকাল করেন। ১১ নভেম্বর দেশ টিভি চট্টগ্রাম অফিসের ক্যামেরাপার্সন হাসান উল্লাহ’র মেজ ভাই মো. হাকিম উল্লাহ, ১৪ নভেম্বর সাংবাদিক নেতা এজাজ ইউসুফী’র মা সখিনা ইউসুফী এবং ২৫ নভেম্বর দৈনিক পূর্বকোণ এর সাবেক সিনিয়র সহ সম্পাদক এস এম শোয়েব খান (৫৮) নগরের সিএসসিআর হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ২৬ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন সাংবাদিক শামসুল হুদা মিন্টু এর মা ফাতিমা বেগম (৭৭)।

গত ২৬ ডিসেম্বর নগরের কল্পলোক আবাসিকের বাসায় সাংবাদিক আবদুস শুক্কুর (৬৮) ইন্তেকাল করেন। একইদিন রাত সাড়ে ৩টায় বৈশাখী টিভির সিনিয়র ক্যামরাপার্সন শীতল মল্লিক এর মা মেনকা মল্লিক (৬৮) এবং গত ২৭ ডিসেম্বর ভোররাত ৩টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবীণ সাংবাদিক তমাল চৌধুরী (৭২)। ২৮ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ৩টায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাহী সদস্য আজহার মাহমুদের পিতা মো. নুরুল আলম এবং ৩০ ডিসেম্বর রাতে নানী আনোয়ারা বেগম (৭৮) ইন্তেকাল করেন।

চট্টগ্রামে বিদায়ী বছরে পত্রিকা, টেলিভিশন, নিউজ অ্যাজেন্সি এবং অনলাইন পোর্টালে কর্মরত ২০ জন সাংবাদিক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। গত ৪ জুন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও ব্র্যাকের সহযোগিতায় সিইউজে ও চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের যৌথ উদ্যোগে ক্লাব চত্বরে করোনা পরীক্ষার বুথ উদ্বোধন করা হয়।

গত ৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত করোনাকালীন সহায়তার চেক দেওয়া হয় ১৩৬ জন সাংবাদিককে। সাংবাদিকদের হাতে চেক তুলে দেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি। এসময় চট্টগ্রামের আরো ২৫ জন সাংবাদিককে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের নিয়মিত সহায়তার চেক তুলে দেন মন্ত্রী।

বিদায়ী বছরে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) আন্দোলনের জেরে গত ৩০ জুলাই থেকে চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকা মালিক ও সম্পাদকদের সংগঠন ‘নিউজপেপার ওনার্স এলায়েন্স’ এর সিদ্ধান্তে পাঁচটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। টানা ১৬ দিন বন্ধ থাকার পর ১৫ আগস্ট থেকে প্রকাশনায় ফিরে চট্টগ্রামের পাঁচটি দৈনিক-আজাদী, পূর্বকোণ, পূর্বদেশ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম মঞ্চ।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।