সাদা জামদানি শাড়ি পরেছেন নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত। এটা মায়ের উপহার।
দুর্গোৎসব উপলক্ষে কেনাকাটা প্রসঙ্গে পূজা বললেন, ‘পূজায় মা-বাবার কাছ থেকে পোশাক উপহার পাই। পূজার জন্য আলাদা করে তেমন কিছু কিনি না। কারণ নাচের বেশভূষার জন্য প্রায়ই কেনাকাটার মধ্যে থাকতে হয়। নাচের জন্যও সবসময় দর্শকের কাছে দেখতে স্বাভাবিক লাগে এমন পোশাক বেছে নিই। ’
ছোটবেলায় অনেক উপহার পেতেন পূজা। এর মধ্যে পোশাকই থাকতো বেশি। তিনি বললেন, “এখন সবাই তাকে টাকা দিয়ে বলেন- ‘কিনে নিও তোমার পছন্দমতো। ’ আসলে আমি একটু খুঁতখুতে স্বভাবের। এজন্য মা-মাসির কাছ থেকে টাকা পাই। এবার পূজা উপলক্ষে পোশাক কিনতে টাকা দিয়েছিলেন মা। পছন্দমাফিক একটি জামা কিনেছি। এটা শ্যাওলা রঙের। মায়ের এটা খুব পছন্দ হয়েছে। ”
মঙ্গলবার (১১ অক্টোবর) দশমীতে পরিবারের সবার সঙ্গে তুরাগ নদীতে বেড়াতে যাবেন পূজা। সেখানে প্রতিমা বিসর্জন দেখবেন তারা। এর আগে সেখানে তিনি গিয়েছিলেন একবার। এবার তার বন্ধুরাও থাকবে। নিজের নাচের দল তুরঙ্গমী ড্যান্স রেপার্টরি থিয়েটারের সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন মণ্ডপে ঘুরেছেন পূজা। দেখা করেছেন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। পূজা বললেন, ‘মন্ডপে গিয়ে প্রতিবারই নাচি। গতবারও মন্ডপে গিয়ে নেচেছি, সিঁদুর খেলেছি। এগুলোই পূজার মূল আনন্দ। ’
দুর্গাপূজায় এরকম আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করাটা পূজার কাছে উপভোগ্য। বিশেষ দিনগুলো পরিবারের সঙ্গেই কাটাতে ভালো লাগে তার। পূজায় চারদিন সকালে মায়ের সঙ্গে মন্দিরে অঞ্জলি দিতে যান পূজা। তবে আগে সপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই অঞ্জলি দিতে যেতেন। এ ছাড়া দশমীতে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে খানাপিনা উপভোগ করেন। তার কথায়, ‘আমি মাঝে মধ্যে রান্না করি। পরিবারের সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে পারলে ভালো লাগে। বিভিন্ন উৎসবে তুরঙ্গমীর সদস্যদেরকে দাওয়াত দিয়ে এনে রান্না করে খাওয়াই। ’
অন্যান্য দিনগুলোতে মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চললেও দুর্গাপূজা এলে নাড়ু, সন্দেশ, মিষ্টি খাবারের লোভ সামলাতে পারেন না পূজা। মন্দিরের খিচুড়ি খেতেও ভালো লাগে তার। হাসতে হাসতে জানালেন ছোটবেলার একটি মজার ঘটনা। ছোটবেলায় পূজার সময় মন্দিরে গেলে ঠাকুমা মিষ্টি খেতে দিতেন না তাকে। তিনি ডায়াবেটিকসে ভুগেছেন। সবসময় এড়িয়ে চলতেন ঠাকুরমশাইদের নজর। আর তাদের চোখে চোখ রাখতে চাইতেন না। কারণ তাদের নজর পড়লেই প্রসাদ খেতে দেবে। পূজার ভাষ্য, ‘এজন্য বারবার চেষ্টা করতাম তাদের নজর যেন আমার দিকে পড়ে। নজর পড়লেই তারা ডেকে আমার হাতে প্রসাদ দিতেন। ’
এমন অনেক স্মৃতি আছে পূজার। একবার বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে কুমারী পূজা উপলক্ষে কুমারী সেজেছিলেন তিনি। তখন তার বয়স চার-পাঁচ বছর হবে। তাকে বলা হলো, মুখ গম্ভীর করে থাকতে হবে। তিনি বললেন, “কিন্তু আমি মুখে হাসি রেখেছিলাম। কারণ আমি ভাবতাম, ক্যামেরায় ছবি তুলতে হলে হাসতেই হবে। ”
গতবারের পূজায় নাচের বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন পূজা। নাচের সঙ্গে তার মিতালী ছোটবেলা থেকেই। মা বলেন, তার মেয়ে নাকি নাচতে নাচতে হাঁটতো! রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমের ওপর মাস্টার্স করেছেন তিনি। সেখানে কীভাবে পূজা উদযাপন করতেন?
প্রশ্নটার উত্তরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে পূজা বললেন, ‘সহপাঠীদের সঙ্গে খুব মজা করতাম। একবার আমরা নৌকায় চড়ে প্রতিমা বিসর্জন দেখতে গিয়েছিলাম গঙ্গায়। অনেকক্ষণ মাঝ গঙ্গায় ঘুরেছি। এরপর সন্ধ্যায় শ্যামবাজারের ঘাটে নামতেই লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মানুষ শুধু হাঁটছে আর হাঁটছে। কোনো যানবাহন নেই। এ কারণে সেদিন অনেক হাঁটতে হয়েছিলো আমাদের সবাইকে। ’
দুই বাংলার দুর্গাপূজা উদযাপনের ভিন্নতা প্রসঙ্গে পূজা বললেন, ‘শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে গড়া কলকাতার প্রতিমাগুলো তুলনামূলকভাবে শিল্পময়। সেখানকার প্রতিমাগুলো ধান, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্নভাবে কারুকাজ করে বানানো হয়। সাজসজ্জার দিক দিয়ে ওপারের মন্দির ও প্রতিমাগুলো একেবারেই ভিন্ন আঙ্গিকের। এ ছাড়া কলকাতায় কারিগরদের অনেক সম্মান রয়েছে। তারা যথেষ্ট সম্মানী পায় প্রতিমা বানানোর কাজে। ’ তার আক্ষেপ- ‘আমাদের দেশের কারিগররা অভাবের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে। তারা তাদের যথেষ্ট প্রাপ্যটুকু পান না বললেই চলে। ’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই পূজার ইচ্ছে ছিলো দেশে ফিরে প্রতিভাবান উঠতি নৃত্যশিল্পীদেরকে নিয়ে কাজ করবেন। তাই তিনি এসে গড়ে তোলেন তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটার। তাদের প্রথম প্রযোজনা ‘ওয়াটারনেস’ নৃত্যনাট্যটি প্রশংসিত হয়েছে। এর মাধ্যমে নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার হিসেবে তার পরিচিতিও ছড়িয়েছে।
তুরঙ্গমী গঠনের পেছনে শিক্ষকদের পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবদের উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছেন পূজা। তার কথায়, ‘মেয়ে হিসেবে আমার নেওয়া এই উদ্যোগটি সহজ ছিলো না। অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে আমাকে। ইচ্ছে করলে স্কুলিং করাতে পারতাম। কিন্তু এতে নৃত্যশিল্পী তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাচের শিক্ষকের কাছ থেকে আর পাওয়ার কিছু থাকে না। তাছাড়া নিজেরাও কিছু করার সুযোগ পায় না। এমন অনেক প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী দেখেছি যারা সুযোগের অভাবে নাচ ছেড়ে দিচ্ছে। পেশাদারি নৃত্যচর্চার জায়গাটি তৈরির উদ্দেশ্য নিয়েই তুরঙ্গমীর যাত্রা শুরু হয়েছে। ’
তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটার প্রসঙ্গে যোগ করে পূজা বললেন, ‘আমি নিজের মাধ্যমে তুরঙ্গমীর অন্যান্য শিল্পীর জায়গাটা পাকা করার চেষ্টা চালাচ্ছি। কিন্তু এমন না যে পূজা সেনগুপ্তই সবসময় প্রধান থাকবে। তুরঙ্গমী এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে সবাই সুযোগ পাবে। ’
তুরঙ্গমী তিনটি নৃত্যনাট্য প্রযোজনা নিয়ে কাজ করছে বলে জানালেন পূজা। এগুলো একে একে মঞ্চে আনতে চান তিনি। এর মধ্যে ‘জল বেহুলা’ এ যুগের এক প্রেমান্ধ কবি ও তার প্রেমিকাকে ঘিরে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এর প্রদর্শনী হবে।
এ ছাড়া ‘মেঘদূতম’ নৃত্যনাট্যটি সাজানো হচ্ছে ভরতনাট্যমের ওপর। তবে মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয় বলে জানালেন পূজা। এজন্যই একটা প্রদর্শনীর পর আরেকটা করতে গিয়ে অনেক সময় চলে যায়। তিনি জানান, আগামী মাসে ‘অনামিকা সাগরকন্যা’ নামের নৃত্যনাট্যটি মঞ্চায়নের চেষ্টা করবেন।
মায়ের উৎসাহে ছোটবেলা থেকে নাচ নিয়ে এগিয়ে আসতে পেরেছেন পূজা। ছোটবেলায় মায়ের আগ্রহে নাচ, গান, অভিনয়, ছবি আঁকা সবকিছু শেখা হলেও নাচকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। নৃত্যশিল্পী হিসেবে নাচ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন পূজা। তার অবসর কাটে নাচ আর তুরঙ্গমী নিয়ে। শরীর ফিট রাখতে নিয়মিত জিম করেন তিনি।
এদিকে সম্প্রতি আল মনসুরের পরিচালনায় ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেছেন পূজা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত এই নাটকের কৃষ্ণা চরিত্রটি নাকি নির্মাতা তাকে ভেবেই লিখেছিলেন! যদিও পূজা নাচ নিয়েই থাকতে চান। অভিনয়ের প্রতি তেমন কোনো আকর্ষণ অনুভব করেন না বলে জানালেন।
নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া পূজার কথায়, ‘তার অনুরোধ রাখতেই নাটকটিতে অভিনয় করেছি। আসলে আমি নাচ নিয়েই থাকতে চাই। নাচের প্রতিই আমার আগ্রহ বেশি। তবে ভবিষ্যতে ভালো গল্প পেলে হয়তো অভিনয় করবো। আসলে বিভিন্ন পথে একসঙ্গে হাঁটা যায় না। আমি নাচের মানুষ, নাচ নিয়েই থাকতে চাই। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৬
জেএমএস/জেএইচ