ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

সালমান শাহ: অকালে হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্র 

রাকিব হাসান রাফি, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০
সালমান শাহ: অকালে হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্র  সালমান শাহ

সেপ্টেম্বর এলেই ১৯৯৬ সাল ফিরে আসে! আক্ষেপের রাগিণী শোনাতে ফিরে আসেন সালমান শাহ। আমার মতে, বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ২ জন ফ্যাশন সচেতন নায়ক ছিলেন; প্রথম জন জাফর ইকবাল আর দ্বিতীয় জন সালমান শাহ।

তাঁরা দুজনই প্রয়াত। তবে জাফর ইকবালের ক্যারিয়ার যেখানে ১৮ বছরের, সে তুলনায় সালমানের ক্যারিয়ারের বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর!

নায়ক হিসেবে সালমান শাহ কোন স্তরের, এই মূল্যায়নের আগে একটা ভিন্ন উদাহরণ দিই, একজন ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি করলেন, পরবর্তীতে আরও কয়েকটা সেঞ্চুরি। তাঁর রানের খাতায় যুক্ত হলো কয়েকটি ফিফটি বা দশের নিচের স্কোর। পরিসংখ্যান যখন এমন, হঠাৎ করে কোনো একটা ম্যাচে গুরুতর ইনজুরিতে পড়ে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় তাঁর।  

ধরা যাক, সবমিলিয়ে তিনি ২৭টি ম্যাচ খেলেছেন, গড় ৪৫। এই ব্যাটসম্যানকে ২০ বা ২৫ বছর পর কীভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি? 

ক্রিকেট আর সিনেমা অবশ্যই এক নয়, কিন্তু দুটোই তো ইন্ডাস্ট্রি। প্রত্যেক ইন্ডাস্ট্রির পারফরমারকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রেই কিছু কমন প্যারামিটার প্রযোজ্য। তবু সালমানের সার্থকতা এখানেই যে, তিনি এই প্রযোজ্যতার বাইরেও আলাদা কিছু ফ্যাক্টরের কারণে আরও ৫০ বছর পরও হয়তো প্রাসঙ্গিক থাকবেন।  

শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন সিনেমায় প্রবেশের আগে মিডিয়াতে খুব বেশি পরিচিত কোনো মানুষ ছিলেন না। '৮৫ সালে হানিফ সংকেতের নির্মিত একটি মিউজিক ভিডিওতে মাদকাসক্ত যুবকের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে শোবিজে আসেন, '৯০ সালের কিছু আগে আব্দুল্লাহ আল মামুনের 'পাথর সময়' নামের একটি নাটকে অগুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন। সেখান থেকে '৯১ সালে কীভাবে সালমান শাহ হয়ে চলচ্চিত্রে এলেন সেই গল্পটা অজানা নয়।  

ইমন থেকে সালমান শাহ হওয়ার পেছনে সম্ভবত বলিউডের সালমান খান নামটি মোটিভেশন হিসেবে কাজ করেছিল। আমাদের দেশী পরিচালকদের বেশিরভাগই তখন হিন্দিতে প্রবলভাবে আসক্ত ছিলেন (এখন অবশ্য তামিল-তেলেগু আসক্তি চলছে)। তাঁর প্রথম সিনেমা 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত'ও তো আদতে আমির খান-জুহি চাওলার একই নামের সিনেমার সিন বাই সিন অনুকরণে নির্মিত। তবু এদেশের দর্শক সিনেমাটি খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল।  

প্রথম সিনেমা দিয়েই সালমান শাহ- মৌসুমী জুটি ইতিহাস নির্মাণের প্রতিশ্রুতি তৈরি করতে পেরেছিলেন। হয়তো বা রাজ্জাক-কবরীর পর আরেকটি অবিসংবাদিত জুটি হতে পারতেন তারা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এই জুটি একত্রে সিনেমা করেছে মাত্র ৪টি।  

সালমানের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা ২৭, এরমধ্যে ১৪টি সিনেমার নায়িকাই শাবনূর। ৩টি সিনেমা করেছেন শাবনাজের সঙ্গে, ২টিতে জুটি বাঁধেন লিমা। বাকিগুলো উঠতি ও অখ্যাত নায়িকার বিপরীতে। যদিও শাহনাজের সঙ্গে 'সত্যের মৃত্যু নেই' সিনেমাটা আলাদাভাবে আলোচিত হয়েছিল এই সিনেমার গান 'চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর, এই দুনিয়া ছাড়তে হবে এসেছে খবর'-এর জন্য। এতে সালমান ছিলেন ফাঁসির আসামী, বাস্তবেও তাঁর মৃত্যু হয়েছে ফাঁসিতে ঝুলেই। ফলে তখন সিনেমাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।  

একটি পয়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। সালমানের মৃত্যুর পর সেই শোকে ৭ তরুণী আত্মহত্যা করে। আর কোনো সুপারস্টারের মৃত্যুতে এধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা, নিশ্চিত করে বলা যাবে না। '৯৬ সালে আমার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর, তাই তখনকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অনেক কিছুই আমি এই সময়ে বসে বুঝতে পারবো না। তবু মাঝে মাঝে বিষয়টি খুব ভাবায়।  

সালমান সুদর্শন, সালমান ফ্যাশন সচেতন, কিন্তু নায়কোচিত যে বলিষ্ঠ দেহসৌষ্ঠব সেটা কি তার ছিল, নাকি চকলেট হিরো হয়েই টিকে থাকতে হতো তাকে! তাঁর মৃত্যুর পর সংবাদমাধ্যমে তুমুল মাতামাতি ছিল, তাঁর মৃত্যু নিয়ে, প্রায় প্রতিদিনই তাঁর মতো দেখতে কোনো না কোনো তরুণের ছবি পত্রিকায় আসতো, এবং বলা হতো, এই হতে পারে পরবর্তী সালমান! এমনকি সালমানের শেষ সিনেমা 'বুকের ভেতর আগুন'-এ তার মুখ পুড়িয়ে দেওয়ার পর কসমেটিক সার্জারি করে তার পরিবর্তে পর্দায় এলেন ফেরদৌস। তাকেও তো সালমানের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবেই চিন্তা করা হচ্ছিল। 'প্রিয়জন' সিনেমায় সালমানের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা রিয়াজকেও সে জায়গায় চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে ফেরদৌসকে 'হঠাৎ বৃষ্টি' করতে হয়েছে, রিয়াজকে করতে হয়েছে 'মনের মাঝে তুমি'। তাঁরা অবশ্য নিজের জায়গায় সফল।

সালমান শাহ ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যান তিনি। অনেকে বলেন তাঁর মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। আমি সেই বিতর্কে যেতে চাই না, সালমান শাহ আর নেই এটাই সত্যি কথা। সালমান বিয়ে করেছিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে, তাঁর শ্বশুর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরা। তাঁর স্ত্রী সামিরা বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী, পুনরায় বিয়ে করেছেন, ৩ সন্তানের মা। জীবন থেমে থাকে না, জীবন চলে জীবনের গতিতে।  

অনেকেই চলে গেছেন, অনেকেই এসেছেন আবার আসবেন। কিন্তু আরেকজন সালমান কী আর আসবেন?  এই প্রশ্নটাতেই শিল্পী হিসেবে সালমানের সার্থকতা। আমার কাছে, সালমান একজন সিদ্ধ শিল্পী, যে কেবল আক্ষেপই বাড়ায়।

ফ্যাশন সচেতন হিসেবে সালমানকে আলাদা করে বলায় অনেকে বলতে পারেন ষাটের দশকের রাজ্জাক বা রহমান কী ফ্যাশন সচেতন ছিলেন না? সময়টা বুঝতে হবে। ষাট এবং সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমার দর্শকদের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন ছিল না। শিক্ষিত, নিম্নবিত্ত সকলেই একইভাবে সিনেমা দেখতেন। বাংলা সিনেমায় বিভাজনটা ঢুকে পড়তে শুরু করে মধ্য আশির দশক থেকে, যখন সাপের সিনেমা, রাজা-রানীর কনসেপ্টে ফোক-নির্ভর সিনেমাগুলো নির্মিত হতে থাকে।  

সালমান যে সময়টাতে চলচ্চিত্রে আসেন তখন সিনিয়র নায়ক আলমগীর ছিলেন, ইলিয়াস কাঞ্চন রাজত্ব করছিলেন, অ্যাকশনের কারণে রুবেলের দর্শক ছিল, শাবনাজ-নাঈম জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলেন, কিন্তু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তরুণ গ্রুপের কোনো তারকার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তরুণীদের মধ্যে ক্রেজ ছিল না। সালমান শাহ এই গোষ্ঠীর মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন; হিন্দি সিনেমার শাহরুখ-সালমান খানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নিজের একটা ক্রেজ তৈরি করেছিলেন। ভিউ কার্ড জমানো তরুণ-তরুণীদের কাছে চাহিদা আদায় করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের আর কোনো নায়ক এই গোষ্ঠীর মনোজগতে এতোটা আলোড়ন জাগাতে সমর্থ হননি। এখানেই তিনি অনন্য।  

সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১-এই থেমে গিয়েছিলেন, সালমান থেমেছেন ২৫-এ। এই স্বল্পায়ু মানুষগুলো জানতেও পারেন না, কত নিযুত আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস প্রজন্মান্তরে তারা সযত্নে উপহার দিয়ে যান।  

লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া!

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০
জেআইএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।