মৌলভীবাজার: বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী তানিয়া খানকে হারানোর পাঁচ বছর আজ। ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শুধু বন্যপ্রাণী নয়, সব ধরনের প্রাণীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। আহত প্রাণীদের মাতৃমমতায় পরিচর্যার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতেন তিনি। সুস্থ হওয়া প্রাণীদের আপন আবাসে ফিরিয়ে দিতেন। এর জন্য তিনি মৌলভীবাজারের পূর্ব-দক্ষিণ কালেঙ্গায় সেভ আওয়ার আনপ্রোটেক্টেড লাইফ (সৌল) নামে সংস্থা গড়ে তোলেন। সকল মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নেবার অসাধারণ মানবিক গুণের অধিকারী ছিলেন তানিয়া খান।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের জন্য প্রথম ও দুর্লভ কিছু পাখি রেকর্ড করেন তানিয়া খান। পাখি ছাড়াও ‘হিমালয়ান মোল’ নামক স্তন্যপায়ী প্রাণী বাংলাদেশের জন্য প্রথম রেকর্ড করেন তিনি। ‘ফলস কোবরা’ নামক সাপ, দুই প্রজাতির ‘ব্যাঙ’ ও ‘চিকিলা’ নামক উভচরও প্রথমবারের মতো রেকর্ড করেন তিনি। বামন মাছরাঙার ওপর গবেষণা করে তিনি পাখি-বিজ্ঞানের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বন্যপ্রাণী ছাড়াও তিনি প্রজাপতির ছবি তুলতেন ও নতুন প্রজাপতি রেকর্ড করেছেন। তাঁর গবেষণাপত্রের সংখ্যা প্রায় ১৫টি। তিনি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য হিসেবে জলচর পাখিশুমারি ও পাখির রিঙ্গিং কর্মসূচিতে বহুবার অংশগ্রহণ করেছেন।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজও করে গেছেন। সেই প্রেক্ষাপটের জীবদ্দশায় তিনি তিনটি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে মরণোত্তর বঙ্গবন্ধু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পদক লাভ করেন তানিয়া খান। তাঁর বহু বন্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণা বাংলানিউজসহ দেশের বহু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
তানিয় খানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তানিয়া আপা ছিলেন অসাধারণ মনের একজন মানুষ। তাঁর ভেতর ছিল স্নেহ-ভালোবাসা, মাতৃত্ববোধ। বন্যপ্রাণীর প্রতি তিনি অনেক দুর্বল ছিলেন। প্রাণীদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আমার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল বড় বোন এবং বন্ধুর মতো। আমরা একসঙ্গে অনেক ফিন্ডওয়ার্ক করেছি। একসঙ্গে বনে দিনে-রাতে প্রচুর বন্যপ্রাণীর ছবি তুলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বন্যপ্রাণী বিষয়ে অনেক ট্রেনিংও করিয়েছি। বন্যপ্রাণীদের উদ্ধার করেছি। ’
আদনান আজাদ আরও বলেন, ‘তানিয়া আপুর হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা হয়ে গেছে, সেটা কখনো পূরণ হবার নয়। বাংলাদেশে খুব কম বন্যপ্রাণী বা পাখি আছে যাকে তিনি তাঁর ক্যামেরায় বন্দি করেননি। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। আমি এভাবে বলতে চাই–কোনো পুরুষও ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফিতে তাঁর ধারে-কাছে ছিল না। প্রচুর ছবি তুলেছেন তিনি। বিভিন্ন বনে এত সময় কাটিয়েছেন তানিয়া আপা। তাঁর দুই পা, দুই হাতে অনেক অনেক জোঁকের কামড়ের চিহ্ন ছিল। তিনি সিলেট বিভাগীয় বনাঞ্চলেই বেশি কাজ করতেন। বাংলাদেশে তাঁর আবিষ্কার করা সাপসহ অনেক বন্যপ্রাণী রয়েছে। প্রজাপতির অনেক ছবি রয়েছে তাঁর তোলা। ’
তিনি বলেন, শেষের দিকে তিনি যখন অসুস্থ হলেন তখন তানিয়া আপার সাথে ফোনে খুব কথা হতো। তানিয়া আপা চেয়েছিলেন, কিছু খাচাবন্দি বিদেশি পাখি পালন করতে। কেইস বার্ডের আমার কিছু অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকার কারণে আমার পরামর্শ নিতেন। যেসব আহত প্রাণীকে তিনি সেবার ও চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতেন সেগুলোর ব্যাপারেও আলোচনা হতো। মহাবিপন্ন প্রজাতির একটি বনরুইকে বাঁচানোর জন্য বন বিভাগের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। সেদিন তানিয়া আপাসহ আপনি-আমি ছিলাম। ওটাই ছিল তানিয়া আপার সাথে আমার শেষ দেখা। এর কিছুদিন পরে তিনি মারা যান।
আদনান আজাদ আরও বলেন, ‘বেঙ্গল ফক্স’ নামের একটা প্রাণী যার বাংলা হচ্ছে খেক শিয়াল। বাংলাদেশে এটি অত্যন্ত দুর্লভ এবং বিরল বলতে পারেন। বাংলাদেশে হাতগোনা দুই-চারটি জায়গায় এই শিয়ালটিকে দেখতে পাওয়া যায়। আমরা সচরাচর যে শিয়ালটাকে দেখি এটা হচ্ছে ‘গোল্ডেন ফক্স’ অর্থাৎ পাতি শিয়াল। বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ওই খেক শিয়ালের ছবি ক্যামেরায় তোলা ওনার খুব শখ ছিল। আমাকে কয়েকবার বলেছিলেন, ‘আদনান ভাই, আমি বেঙ্গল ফক্সের ছবি তুলতে উত্তরবঙ্গ আসতে চাই ...। ’ আমার কাছে চাওয়া ওনার শেষ ইচ্ছা ছিল। এই ইচ্ছাটা আর পূরণ হয়নি। এরপর আমি যখনই বেঙ্গল ফক্সের ছবি তুলেছি তখনই তানিয়া আপার কথা খুব মনে পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২৪
বিবিবি/এমজেএফ