লক্ষ্মীপুর: মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকায় লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক। সড়কের দুই পাশে সবুজ বেষ্টনীর আওতায় বনবিভাগের পক্ষ থেকে বনায়ন করা হয়েছে।
২০০৫ সালে লাগানো গাছগুলো এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যেন আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে।
গাছের কারণে পুরো সড়কটি ছায়া-শীতল থাকছে। সেই সঙ্গে দেখতেও খুব সুন্দর লাগে। সড়কের পাশে থাকা নানা প্রজাতির বনজ গাছের সঙ্গে ওষুধি, ফলদ গাছ রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
কিন্তু লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কে এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বেশি দিন থাকবে না। সড়কের দুপাশের গাছগুলো কাটা পড়ছে। এ সড়কটি সম্প্রসারণ করা হবে, ফলে কেটে ফেলা হবে সবুজ বেষ্টনীর গাছগুলো।
সড়ক উন্নয়নের জন্য পাঁচ বছর আগে নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর-রায়পুর মহাসড়কে দুপাশে থাকা শতবর্ষী গাছসহ সব গাছ কেটে ফেলা হয়। সড়ক সম্প্রসারণের জন্য ২০২০ সালের দিকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় মহাসড়কের পাশে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার গাছ কাটা হয়। ফলে এ দুই সড়কে এখন কোনো গাছ নেই। ফলে তপ্ত রোদে ওষ্ঠাগত অবস্থা হয় পথচারীদের। সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকেও বন বিভাগকে সড়কের পাশে বনায়ন করার অনুমতি দিচ্ছে না। তবে মজুচৌধুরীর হাট সড়কের একটি অংশের দুপাশে কিছু গাছ লাগিয়েছে বন বিভাগ। এখন ঢাকা-রায়পুর মহাসড়কের লক্ষ্মীপুর অংশ খালি পড়ে আছে।
স্থানীয়রা বলছেন, উন্নয়নের নামে দিনের পর দিন বন ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু সে হিসেবে বনায়ন করা হচ্ছে না। সড়কের পাশে গাছ রেখে বিকল্প ও পরিকল্পিত পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়ন করা যেতে পারে। এতে উন্নয়নও হবে, পরিবেশও রক্ষা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর সড়ক বিভাগের আওতাধীন লক্ষ্মীপুর-চর আলেকজান্ডার-সোনাপুর-মাইজদী সড়কটি ৫.৫০ মিটার থেকে ৭.৩০ মিটার প্রশস্ত করা হবে। লক্ষ্মীপুর অংশে (লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক) ৫৪ কিলোমিটার সড়কে বনবিভাগের লাগানো গাছ রয়েছে। গাছগুলো কাটার জন্য গেল বছরের নভেম্বরে লক্ষ্মীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের পক্ষ থেকে বন বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। এ সড়কে ২০০৫ সালের দিকে বন বিভাগের লাগানো গাছের সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৪৫।
এছাড়া রামগতি উপজেলার নুরিয়া হাজিরহাট-নুরু পাটওয়ারী সড়কের দুপাশে রাস্তার সাইড ওয়েন্ডিং করার জন্য ওই সড়কের কেরামতিয়া বাজার থেকে ভূলুয়া ব্রিজ হয়ে পূর্বদিকে চৌরাস্তা হয়ে জোগির মোড় পর্যন্ত বন বিভাগের লাগানো গাছ কাটার জন্য গেল বছরের ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ওই সড়কে বন বিভাগের লাগানো গাছের সংখ্যা ১৬৭২। ২০১১ ও ২০১২ সালের দিকে গাছগুলো লাগানো হয়।
অন্যদিকে রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া বাজার থেকে লামচর উচ্চ বিদ্যালয় ও আজিমপুর থেকে করপাড়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কে বন বিভাগের ১৮৭টি গাছ রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ওই সড়কটির ‘উন্নয়নের বাঁধা’ ১২৫টি গাছ কাটার জন্য গেল বছরের সেপ্টেম্বরে বন বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়।
বন বিভাগ সূত্র জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের পাশে ১৩ হাজার ৪৪৫টি, রামগতি উপজেলার ১৬৭২টি এবং রামগঞ্জ উপজেলার ১২৫টিসহ মোট ১৫ হাজার ২৪২টি গাছ কাটার জন্য জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটি অনুমোদন দেয়। ফলে নিলাম প্রক্রিয়ার জন্য ওই সব গাছে ‘নাম্বারিং’ করা হয়েছে। তবে নিলাম প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি। যে কোনো সময় এ গাছগুলো কাটা পড়বে।
সড়ক উন্নয়নের লক্ষ্যে আগেও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন সড়ক এবং মহাসড়কের পাশে থাকা গাছ কাটা হয়েছে। কিন্তু এরপর কিছু কিছু সড়কে আর লাগানো হয়নি গাছ। বিশেষ করে লক্ষ্মীপুর-রায়পুর-নোয়াখালী মহাসড়কের পাশে থাকা শতবর্ষী গাছসহ নানা প্রজাতির গাছ পাঁচ বছর আগে কাটা হলেও নতুন করে বনায়ন করা হয়নি। লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরীর হাট সড়ক সম্প্রসারণের সময় গাছ কেটে ফেলার পর কিছু অংশে আবার গাছ লাগানো হয়। তবে সড়কের বেশিরভাগ অংশের পাশই খালি পড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুর-রায়পুর-নোয়াখালী মহাসড়কের পাশের বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল হাদী বলেন, এ মহাসড়কের পাশে বড় বড় গাছ ছিল। কিন্তু সড়ক উন্নয়নের নামে কয়েক বছর আগে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। এরপর আর গাছ লাগানো হয়নি। গাছ থাকাকালে গাছের ছায়ায় পুরো সড়ক শীতল থাকত। এখন তপ্ত রোদে সড়ক উত্তপ্ত থাকে। শীতল ছায়ার বদলে রোদের উত্তাপ ছড়াচ্ছে সড়ক।
কমলনগরের তোরাবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা সানা উল্যা বলেন, মেঘনার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ জেলাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস লেগেই থাকে। সে জন্য বেশি করে গাছ লাগানো প্রয়োজন। কিন্তু গাছ লাগানোর পরিবর্তে কাটা হচ্ছে।
তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর-রামগতি মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করি। এ সড়কের দুপাশে নানা প্রজাতির গাছ লাগানো আছে। গাছের ছাড়ায় পুরো সড়ক শীতল থাকে। দেখতেও লাগে অনেক সুন্দর। কিন্তু শুনেছি সড়ক সম্প্রসারণের জন্য গাছগুলো কাটা পড়বে। গাছ কাটার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে গাছ লাগানোর সিদ্ধান্তও যেন নেওয়া হয়।
লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর ফরহাদ হোসেন সুমন বলেন, যেভাবে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কাটা হচ্ছে, সেভাবে আর গাছ লাগানো হচ্ছে না। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। দিন দিন গাছের সংখ্যা কমার কারণে তাপদাহ তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রকৃতিতে যেমন গাছের প্রয়োজনীয়তা আছে, তেমনি উন্নয়নেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। গাছ না কেটে গবেষণার মাধ্যমে বিকল্প পদ্ধতিতে উন্নয়ন করা যেতে পারে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গাছ মাটি থেকে পানি শোষণ করে। পরিমাণমতো পানি নিজে গ্রহণ করে বাকিটা বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। এতে বায়ুমণ্ডল শীতল থাকে এবং বৃষ্টিপাত হয়। যে অঞ্চলে গাছের সংখ্যা বেশি, ওই সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতও বেশি হয়।
গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন নির্গত করে। এতে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে যত বৃক্ষ থাকা দরকার, তত বৃক্ষ না থাকায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় তাপমাত্রা বাড়ছে। তাই গাছ না কেটে আমাদের বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, যোগ করেন তিনি।
গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ফিরোজ আলম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সড়ক প্রশস্ত করার জন্য গাছগুলো কাটা পড়বে। এটা সড়ক ও জনপথ বিভাগের সিদ্ধান্ত। আমাদের সিদ্ধান্তে গাছ কাটা হয় না।
তিনি বলেন, তাপদাহ কমাতে বা পরিবেশ শীতল রাখতে গাছের বিকল্প নেই। যেখানে গাছ কাটা পড়বে, সেখানে আমরা আবার বাগান করি। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ আমাদের গাছ লাগাতে দেয় না। তারা নিজেরা লাগায়। কিন্তু যাদের যে কাজ, তাদের সেটাই করতে হয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গাছ অল্প কয়েকটা, বেশি না। এটাতে কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে? একটু অ্যানালাইসিস করে দিন।
তিনি বলেন, রাস্তা সম্প্রসারণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গাছের গোড়াগুলো হালকা, রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। গাছের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার জন্য রোদ ভালো। গাছের ছায়া পড়লে রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। ছায়ায় রাস্তায় শ্যাওলা পড়ে, দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে।
গাছ কাটার পর লাগানোর বিষয়ে তিনি বলেন, গাছ কাটার পর লাগানো হয় না, তা কিন্তু না। ফলের গাছ লাগাতে আমরা উৎসাহিত করি।
জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বাংলানিউজকে বলেন, গাছ কাটার আগে গাছ লাগাতে হবে। কিন্তু সব সময় হয়ত এটা হয়ে ওঠে না৷ সম্প্রতি যেহেতু তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল, এখন গাছ লাগানো খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। তারপরও এ বিষয়টা নিয়ে আমরা বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। মজুচৌধুরীর হাট সড়কে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এ বর্ষায় আমরা সেখানে গাছ লাগাব।
তিনি বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নতুন ভবনের জন্য কিছু গাছ কাটা পড়বে। যত গাছ কাটা পড়বে, তার চাইতে বেশি গাছ ওখানে লাগিয়েছি। যাতে কিছু গাছ কাটা পড়লেও ওই গাছগুলো বড় হয়।
রামগতি সড়কে গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়টা খেয়াল রাখছি। তারপরও গাছ লাগানোর বিষয়ে যেহেতু আলোচনা হচ্ছে, আমরা বন বিভাগের সঙ্গেও কথা বলব।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৪
এসআই