ঢাকা: মৌমাছি পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে উপকারী পতঙ্গদের একটি। বিশ্বব্যাপী যত ফুলের পরাগায়ন হয় তার সিংহভাগ হয় মৌমাছির মাধ্যমে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের নানা গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী মৌমাছির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে বিগত কয়েকবছর ধরে। ইউরোপ, আমেরিকার অধিকাংশ দেশ বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। তারা ইতোমধ্যে নিতে শুরু করেছে নানা পদক্ষেপ। মৌমাছি বিলুপ্তির কারণ খুঁজতে তারা চালাচ্ছে নানা গবেষণা। এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে ভয়ংকর সব বিষয়ও। তবে মৌমাছি টিকে থাকার প্রধান হুমকি যে কীটনাশকের ব্যবহার-এ বিষয়ে একমত প্রায় সব দেশ।
তাই মৌমাছি বাঁচাতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে নিষিদ্ধ করেছে মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর সব কীটনাশকের উৎপাদন ও ব্যবহার।
ইউরোপীয় কমিশন বিশ্বব্যাপী মৌমাছির উপনিবেশ রক্ষায় শক্তিশালী ও কার্যকরী উদ্যোগ নিয়েছে। মে মাসে কমিশন আইন প্রণয়ন করে দুই বছরের জন্য নিয়োনিকোটিনয়েস জাতীয় কিছু কীটনাশক ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এই কীটনাশক গাছের টিস্যুর মধ্যে বাসা বেঁধে ফুলের পরাগে অবস্থান করে এবং মৌমাছি এর পরাগয়নে সাহায্য করে। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। কীটনাশক প্রস্তুতকারকরা এটা আর উৎপাদন করতে পারবে না।
বিশেষ করে গত ১৫ বছর বা তার কিছু বেশি সময় ধরে পশ্চিম ইউরোপে মৌমাছি চরম হুমকিতে রয়েছে। ইউরোপীয় কমিশন ২০১২ সালে ১৭টি অঙ্গরাজ্যকে নিযুক্ত করে এর যথোপযুক্ত কারণ খুঁজে বের করতে।
এরপর ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা। এতে বলা হয়, নিওনিকোটিনয়েড নামক কীটনাশকের ব্যবহার মৌমাছির স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এটা নিষিদ্ধ করা উচিত।
ইটালীয়ান এক গবেষণায়ও দেখা গেছে, মাঠ চষে বেড়ানো মৌমাছির দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ নিওনিকোটিনয়েডসের ব্যবহার।
এই কীটনাশক প্রস্তুতকারক দুই ইউরোপীয় কোম্পানি ‘বেয়ার ক্রপসায়েন্স ইন জার্মানি’ ও সুইজারল্যান্ডের সিনজেনটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিচার আদালতে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। কোম্পানি দুটি বলছে, যদি নিওনিকোটিনয়েড নিয়ম মেনে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এটি মৌমাছির কোনো ক্ষতি করবে না।
এখানে বিজ্ঞানীরা কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। কারও কারও মতে, নিওনিকোটিনয়েড ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় কৃষকরা আরও ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার শুরু করতে পারে, যা মৌমাছির আরও বেশি ক্ষতি করবে।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচিতে মৌমাছি স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে এমন একাধিক কারণের রূপরেখা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। উদ্ভিদনাশক ও কীটনাশক মৌমাছি ছাড়াও বাসস্থানের অবনতি, ভাইরাস, প্যারাসাইট, কীট, বায়ু দূষণ ও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্ষেত্রের জন্যও হুমকি।
এছাড়া ক্ষতিকার কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে জুন মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশ্বব্যাপী মৌমাছি রক্ষা ও পরাগায়নে ইউরোপীয় সপ্তাহে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি ও আফ্রিকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মৌমাছি স্বাস্থ্য উন্নীত ১৩.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার মৌমাছি পালক ও পরিবেশবাদী একটি গ্রুপ দুই ধরনের নিওনিকোটিনয়েড কীটনাশক নিষিদ্ধের দাবিতে এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি বিরুদ্ধে মার্চ মাসে একটি মামলা দায়ের করে।
জুন মাসে একটি পার্কিং লটের গাছে এই জাতীয় কীটনাশক স্প্রে করলে প্রায় ৫০ হাজার মৌমাছি একসঙ্গে মারা যায়। তখন সাময়িকভাবে এই কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগেও কিছু কিছু দেশে সাময়িকভাবে এই কীটনাশক নিষিদ্ধ ছিল।
এদিকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন এজেন্সি মৌমাছির স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না রাখতে পারে তাহলে মার্কিন কংগ্রেসে একটি পলিনেটরস অ্যাক্ট বিল উত্থাপন করে নিয়োনিকোটিনয়েডস কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। এমনটি সিদ্ধান্ত ছিল।
তবে একটি সহজ সত্য হলো- বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্যের পরাগায়ন হয় মৌমাছির মাধ্যমে। তাই নিওনিকোটিনয়েডের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা একটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ বলেই ধরে নেওয়া যায়।
কারণ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা যখন হুমকিতে তখন এই পদক্ষেপকে নিঃসন্দেহে সাধুবাদ জানানো যায়।
এসবের পর বেয়ার কোম্পানি জানিয়েছে, তারা মৌমাছির ব্যাপারে বেশ সচেতন অবস্থানে রয়েছে। কোম্পানিটির একজন কর্মকর্তা জিলিয়ান ম্যানসফিল্ড বলেছেন, বেয়ার কঠোরভাবে মৌমাছির স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্র বিগত পাঁচ বছর ধরে একটি গবেষণা চালিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে, গত পাঁচবছরে দেশটিতে ত্রিশ শতাংশ মৌমাছি কমে গেছে। মানুষ সৃষ্ট বিরুদ্ধাচরণে তাদের এই অবস্থা। বসন্তে ফুলের ভর মৌসুমেও তারা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় ৫০ ভাগ বেশি।
স্পেনে এই হার আরও আশঙ্কাজনক। তাদের হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে অস্ট্রেলিয়া বা কানাডার মতো দেশ এখনো কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি।
তবে বিজ্ঞানি ও গবেষকরা বলছেন, মৌমাছি ও পরাগায়নে সাহায্যকারী পতঙ্গের টিকে না থাকতে পারার প্রধান কারণ নিওনিকোটিনয়েড জাতীয় কীটনাশকের মাত্রারিক্ত ব্যবহার।
যুক্তরাষ্ট্রের মৌচাষিরা পেঁপে, কাজুবাদাম,বাদাম, আপেল ও নানা ফল সবজির ক্ষেতে তাদের মৌবাক্স রাখেন। এতে ফুল এলে পরাগায়ন সুবিধা হয়। আর মৌমাছি যদি পরাগায়নে সাহায্য না করতে পারে তাহলে ফল, সবজি কোনোটিই পুষ্ট বা সুস্বাদু হয় না, বেশি হয় না উৎপাদনও। তাই মৌমাছি ও এই জাতীয় পতঙ্গের কমে যাওয়া একটি আতঙ্কের বিষয়।
নিওনিকস যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে ভুট্টা, সয়া সব, তুলা,ক্যানোলা চাষিদের কাছে একটি জনপ্রিয় কীটনাশক। কৃষকরা বীজ ভালো রাখতে উপকার পান ঠিকই কিন্তু বৃহৎ স্বার্থে এটি লাভের চেয়ে ক্ষতিই করছে বেশি। ১৯৯০ সাল থেকে এই জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার শুরু হলেও ২০০৪ সালের পর থেকে মৌমাছির জন্য যে এটা ক্ষতির কারণ তা গবেষণায় বেরিয়ে আসে যখন মৌমাছির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে।
২০০৬ সালে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা শুরু হয়। এবং একটি গ্লোবাল রিসার্চ গ্রুপও নিওনিকোটিনয়েডকে মৌমাছির হুমকির প্রধান কারণ চিহ্নিত করেন।
এরপর বিশ্বের সব শক্তিশালী মিডিয়াগুলো এই কীটনাশক নিষিদ্ধের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের প্রথম পাতায় একবার ও দুবার এডিটোরিয়াল প্রকাশ করে এ বিষয়ে। ফোবর্স, সিবিএস নিউজ, ড্যান র্যাদা, এনপিআরও সোচ্চার হয়ে ওঠে।
কিন্তু রয়েছে এর বিরুদ্ধ মতও। নিওনিকোয়েড উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বেয়ারের মতো অনেকের মতে, নিওনিকোয়েড বা এই জাতীয় কীটনাশক নয়, মৌমাছি মৃত্যুর জন্য দায়ী ভ্যারোরা মাইট নামের অন্য একটি কীটনাশক।
সবচেয়ে বেশি ক্যানোলা উৎপাদক দেশ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাংশের কৃষকরা বলছেন, ক্যানোলা থেকে উৎপাদিত মধু বিশ্বের এক নম্বর সাদা মধু। উৎপাদনও প্রচুর। নিওনিকোটিনয়েড এর ক্ষতির কারণ হলে এমনটি হতো না।
আবার এই কীটনাশকের উৎপাদক দেশ জার্মানি ও কিছু কীটনাশক বিশেষজ্ঞও বলছেন, মৌমাছির উপনিবেশ ধ্বংসের জন্য ভ্যারোরা ব্যবহার দায়ী।
বিস্ময়কার একটি তথ্য হলো- একটি মৌমাছি ঘণ্টায় ষোলো কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে। এবং এরা এক পাউন্ড মধু আহরণে প্রায় ২০ লাখ ফুল ব্যবহার করে।
এ থেকেও অনেকটা স্পষ্ট একটি মৌমাছি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য পরাগায়নে সাহায্য করে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে গবেষণা ও আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট বিশ্বব্যাপী মৌমাছির উপনিবেশ ধ্বংস, মৌমাছির স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যুর জন্য দায়ী কীটনাশক। এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিওনিকোনয়েডস অন্তত দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করায় এ দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে যে, মৌমাছি বাঁচাতে কীটনাশক নিষিদ্ধের কোনো বিকল্প নেই।
ফুল, ফসলের দেশ বাংলাদেশও মৌমাছির উপনিবেশ নিয়ে রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। বিশেষজ্ঞ ও মৌচাষিদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশে মৌমাছির ঝুঁকি নিয়ে নানা তথ্য। এসব বিষয়ে জানোবো পরবর্তী নিবন্ধে।
নিউইয়র্ক টাইমস ও ফোর্বস অবলম্বনে
বাংলাদেশ সময়: ০৬১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৩