ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

অরণ্যে ফিরতে পারবে কি অসহায় উলি মাংকিরা?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮
অরণ্যে ফিরতে পারবে কি অসহায় উলি মাংকিরা? তুলতুলে উলের মতো পশমের উলি মাংকি

চশমাছোপ ভাল্লুক আর পাহাড়ি টাপিরের জন্য বিখ্যাত কলাম্বিয়ার আন্দিজ পর্বতমালার বনাঞ্চল। একসময় এ বনে অহরহ দেখা মিলতো দর্শনীয় উলি মাংকি। উলের মতো কালচে-বাদামি পশম আর লম্বা লেজের এই প্রাইমেট (উন্নত হাত, পা ও বড় মস্তিষ্কবিশিষ্ট একটি বর্গ) প্রজাতিটি বর্তমানে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। গত অর্ধ শতাব্দী জুড়ে আবাস্থল ধ্বংস, চোরা শিকার ও পোষা প্রাণী হিসেবে পাচার হতে হতে এদের সংখ্যা এখন হাতেই গুন ফেলা সম্ভব। 

এভাবে চলতে থাকলে এই প্রাণীটি খুব শিগিগিরই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে, এমনটাই আশংকার কথা জানান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। জানানো হয়, এরইমধ্যে কলাম্বিয়ার বনাঞ্চলগুলো থেকে এই বানরগুলো একেবারেই হারিয়ে গেছে।

এই বানর প্রজাতিটিকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে একজোট হয়ে মাঠে নামে ক্রান্তীয় অঞ্চলের বন্যপ্রাণী গবেষণা সংস্থা ও কলাম্বিয়ার আন্দিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিশেষজ্ঞ। পাচারের কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া কয়েকটি উলি মাংকিকে আবারও বনাঞ্চলে ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় থাকা বন্যপ্রাণী অবমুক্ত করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বন্দি প্রাণীগুলো বন্যপরিবেশে আত্মরক্ষা, খাদ্য অনুসন্ধান, বংশবিস্তারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভুলতে বসেছে। বিশ্বব্যাপী পরিচালিত বন্যপ্রাণী অবমুক্তকরণ কার্যক্রমের হিসেব অনুযায়ী, শতকরা ২৬ শতাংশ প্রাণী বন্দি অবস্থা থেকে সফলভাবে বন্য পরিবেশে ফিরে যেতে পারে।  

অবমুক্তকরণ সফল করতে কলাম্বিয়ার বিভিন্ন চিরিয়াখানা ও আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান পাওয়া উলি মাংকিদের মধ্যে থেকে স্বাস্থ্যবান ও প্রজননক্ষম ১১টি বানরকে বাছাই করা হয়। এরপর প্রায় একবছর এদের পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করেন বিশেষজ্ঞরা।  পুনর্বাসনের জন্য উলি মাংকিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন একজন বিশেষজ্ঞ ৩- উলি মাংকিদেখা যায়, দীর্ঘদিন খাঁচায় বন্দি থাকার কারণে বানরগুলো গাছে চড়বার বদলে সারাক্ষণ মাটিতেই ঘুর ঘুর করে। নিজে থেকে খাবারের সন্ধান করা বাদ দিয়ে মানুষের দেওয়া খাবারের আশায় অপেক্ষা করে। এমনকি শিকারি প্রাণীদের থেকে আত্মরক্ষার অভ্যাসটি একেবারেই ভুলে গেছে।

টিকে থাকার আদিম প্রবৃত্তিগুলো এই বানরদের মধ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য এদেরকে ছয় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে আনা হয়। কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে। গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে খাবার রেখে দেওয়া হয়, যাতে তাদের মধ্যে খাবারের সন্ধান করার প্রবৃত্তি জন্মে এবং গাছে চড়তে উৎসাহী হয়। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে একই খাঁচায় এদের রাখা হয়, যা এই বন্যপরিবেশে টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

শিকারি প্রাণীদের কবল থেকে আত্মরক্ষা শেখানোর জন্য ঈগল বা জাগুয়ারের আওয়াজ রেকর্ড করে বাজানো হয়, রেকর্ডে একইসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় বানরের ভয়ার্ত কান্নার শব্দ, যাতে এদের পক্ষে বিপদটা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৭’র আগস্টে ছয়টি উলি মাংকি অবমুক্ত করা হয় দক্ষিণ হুইলার বনাঞ্চলে। রাজধানী বোগোতার প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণের এই বনটিতে একসময় উলি মাংকিদের অনেকগুলো দল বসবাস করতো। বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে আর কোনো উলি মাংকির দেখা না মিললেও, বর্তমানে বনটি পাচারকারীদের হাত থেকে সুরক্ষিত এবং খাদ্যে সমৃদ্ধ।  

অবমুক্ত হওয়া ছয়টি বানরের চারটি পূর্ণবয়স্ক ও দু’টি শাবক। ট্রেকিং কলারের সাহায্যে এদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন বিশেষজ্ঞরা। খাবারের অনুসন্ধান ও নতুন সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাপারে প্রথম প্রথম মানুষ সাহায্য করতো। পাঁচ মাস পর পুরোপুরি নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া হয় বানরগুলোকে। অসহায় উলি মাংকিরা পায় মুক্তির স্বাদ। আর তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সম্ভাবনায় সফলতার দেখা পান বিশেষজ্ঞরা। উলি মাংকিতবে প্রথম প্রচেষ্টায় সফলতার দেখা মেলে না। কিছুদিনের মধ্যেই বিপদজনক পরিস্থিতির মুখ থেকে দু’টি বানরকে উদ্ধার করে ফেরত আনা হয়। বাকিদের দেখা যায়, গাছের বদলে মাটিতেই ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে বেশিরভাগ সময় এবং এরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে অনাগ্রহী। কিছু দিনের মধ্যেই দু’টি বানর মারা যায় এবং বাকি দু’টির কোনো হদিস পাওয়া যায় না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভুল স্থান বাছাইয়ের কারণেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। হুইলা বনাঞ্চলে খাওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণ ফলমূল থাকলে, জায়গাটি বেশ ঠাণ্ডা। কম তাপমাত্রায় দেহকে গরম রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণ শক্তির ব্যয় হয়। এই আবহাওয়ায় দেহে প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সরবরাহ করতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য সন্ধানের দক্ষতা বানরগুলো তখনও আয়ত্ত করতে শেখেনি।  

তাছাড়া দলটির মধ্যে তেমনভাবে একতা গড়ে ওঠেনি। ফলে এরা প্রায়ই দল ফেলে একা ঘুরে বেড়াতে থাকে, বন্যপরিবেশে যা খুবই বিপদজনক। বিশ্বের প্রথমসারির একদল প্রাণিবিশেষজ্ঞের এই কার্যক্রমই বলে দেয়, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের জনসংখ্যা পুনরুদ্ধার করা কোনো সহজ কাজ না। এরপরও প্রকৃতির এই সৃষ্টিগুলো বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা দিনরাত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তারা।

কলাম্বিয়ান প্রাইমেটোলজি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডায়ান গুজমান জানান, কলাম্বিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাইমেটসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বর্তমানে বিপদাপন্ন যা দেশটির মোট জীববৈচিত্র্যের প্রায় অর্ধেক। এদের মৃত্যু পরিবেশের জন্য করুণ পরিণতি বয়ে আনবে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রাইমেটরা প্রচুর ফলমূল খায় এবং এদের ফেলে দেওয়া ফলের উচ্ছিষ্টাংশ ও বীজ ক্রান্তীয় অঞ্চলের বনের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রতিবছর কলাম্বিয়ায় পাচারকারীদের কবল থেকে বহু বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হলেও, এদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চিড়িয়াখানা বা অভয়ারণ্য দেশটিতে নেই। অনেক সময় অনুপযুক্ত পরিবেশে এদের অবমুক্ত করা হয়। এদিকে বন্দিদশার কারণে বাকিদের নানাবিধ স্বাস্থ্য বিপর্যয় দেখা দেয়।

উলি মাংকিদের বাঁচানোর লক্ষ্যে পরিচালিত বিশেষজ্ঞদের এই দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম অনেক ব্যয়বহুল। কলাম্বিয়ার সরকারের অর্থায়নে এ খাতে প্রতিটি বানরের পেছনে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারেরও (প্রায় চার লাখ টাকা) বেশি খরচ হচ্ছে। এর চেয়ে বরং চোরাকারবারিদের থেকে একটা বানর অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই বিপদাপন্ন প্রাণীদের উদ্ধার করে তাদের আবাস্থলে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা তা অর্থের মাপকাঠিতে মাপার যায় না।

সবশেষ খবরে জানা যায়, গত নভেম্বরে (২০১৮) আরও ছয়টি বানর অবমুক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এবার তারা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও খাদ্য সমৃদ্ধ রে জামুরো বনাঞ্চলকে বেছে নিয়েছেন। প্রতিটি বানরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বন্যপরিবেশে এখনও পর্যন্ত ভালোই করছে এই দলটি। এদের মধ্যে একতা রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, সফলভাবেই প্রকৃতির মাঝে ফিরে যেতে পারবে এরা।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮
এনএইচটি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।