মৌলভীবাজার: দুই জেলাতেই যেন লীলাখেলা! মানে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি! এই আয়ুষ্কালের ভেতরেই সংযুক্ত জীবনের সব গল্পের সীমারেখা। আর তার সাথে তো রয়েছেই মৎস্যপ্রেমী ভোজনরসিক বাঙালির তৃপ্তি।
চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলের প্রতিদিন সকালে ভরে ওঠে পানিপূর্ণ পোনা আর ভার বোঝাই ফেরিওয়ালাদের পদচারণায়। প্রতিটি ভারে করে এসব পোনা হবিগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে নিয়ে আসেন তারা। তারপর প্রয়োজনীয় যানবাহনের জন্য তাদের অপেক্ষা। গন্তব্য তাদের শ্রীমঙ্গল উপজেলা হয়ে কমলগঞ্জ উপজেলায়।
মাঝেমধ্যে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ মৎস্য ক্রেতাদের সাথেও দেখা হয়ে যায়। চলে এসব পোনার দরদাম। এলাকার ক্ষুদ্র মাছ চাষিরা এসব ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে পোনা কিনে নিয়ে নিজেদের পুকুরে ছাড়েন। ধীরে ধীরে ছয় মাস বা আট মাস পর যখন সেই পোনাগুলো বড় হয়। তখন এগুলোই মৎস্যপ্রেমীদের তৃপ্তির চাহিদা পূরণ করে থাকে।
এসব ফেরিওয়ালাদের একটি বিশেষ ব্যবসায়িক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তাহলে তারা যতক্ষণ বসে থাকেন গাড়ির জন্য কিংবা ক্রেতার জন্য ততক্ষণ মৎস্য পোনা পূর্ণ সেই ব্যবসায়িক পাত্রটি বার বার দুলতে থাকেন। খুব জোরে নয়, আবার খুব ধীরেও নয়। মাঝামাঝিভাবে। তাতে ব্যবসায়ীর সব স্বপ্ন আর সম্ভবনাগুলো জীবন্ত থাকে। মরে যায় না। অর্থাৎ এভাবে দুলানোর ফলে ছোট মাছ ওই পাত্রের পানি থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনটুকু গ্রহণ করার সুযোগ পায়।
সম্প্রতি এক সকালে হবিগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গলে ব্রিগেড মাছের পোনা নিয়ে এসেছেন দুই ফেরিওয়ালা। তাদের দুইজনেরই বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার লস্করপুরে।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তাদের একজন মো. লাল মিয়া জানালেন, ‘এগুলো লস্করপুরের দিঘির পোনা। এগুলো বয়স প্রায় ৭ থেকে ৮ সপ্তাহ। চারটা বড় হাঁড়িতে ৫ থেকে ৬ হাজার পোনা রয়েছে। আর কেজির হিসাব ধরলে প্রায় ২০ কেজি ব্রিগেডের পোনা। লস্করপুরের পোনার আড়তদার করম আলীর কাছ থেকে এগুলো আমার কিনেছি। তবে শুধু একজন আড়তদারের কাছে থেকে নয়, অনেকের কাছ থেকেই আমরা মাছ কিনে আনি। ’
লাভের হিসাবে অপর ফেরিওয়ালা মাসুদ মিয়া জানান, ভোর ৫টার দিকে আমরা লস্করপুর থেকে রওয়ানা দেই শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সারা দিন পোনার ভার ফেরি করে প্রায় ৫শ থেকে ৬শ টাকা হয়। আমরা দুইজনেই প্রায় ১৫/২০ বছর ধরে এ ব্যবসায় জড়িত। কোনো মতে জান বাঁচাইয়া চলা আর কি!
এই দুই ফেরিওয়ালা কাছে থেকে চার কেজি ব্রিগেড পোনার কেজি প্রতি ২৫০ টাকায় কিনলেন প্রান্তিক মৎস্যচাষি সুরজিত দাস।
তিনি বলেন, ‘হাঁড়ি থেকে এই পোনাগুলো কিনতে গেলে ভালো করে দেখে কিনতে হবে। যাতে পোনাগুলো সুস্থ-সবল আছে কি না, তাহলে মাছগুলো নষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে না। আর ওজনের থেকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে ফেরিওয়ালা পানিসহ মাছ আপনাকে ওজন করে দিয়ে দেবেন। আপনি কেজিতে মাছ কম পাবেন। ’
শ্রীমঙ্গলের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফারাজুল কবির বাংলানিউজকে বলেন, এসব পোনা মাছের ফেরিওয়ালারা মৎস্য সম্প্রসারণে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমরা মৎস্যচাষিদের এ ধরনের হাঁড়ি-পাতিলের মাছ কিনতে নিরুৎসাহিত করি। কারণ, মাছগুলো কম পানির মধ্যে থাকে। ভারে করে বিক্রির জন্য নিয়ে এলে অনেক সময় এসব পোনা শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। হাঁড়ি-পাতিল ও হাতের বারি খায় ফলে পোনাগুলো সবল থাকার বিপরীতে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই মাছগুলোর সাইজ দুই থেকে তিন ইঞ্চি হয়ে থাকে। এগুলো পুকুরের পানিতে ছাড়লে অর্ধেক মাছই নষ্ট হয়ে যায় বা অনেক ক্ষেত্রেই মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, এখন আমরা প্রান্তিক মৎস্যচাষিদের বলি, যদি পারেন তবে বড় পলিথিনে করে বা বড় ড্রামে করে পোনা আনতে হবে। তাতেই মাছটি সুস্থ সবল থাকে। যেসব প্রান্তিক মৎস্যচাষিদের কম পোনার প্রয়োজন তারা এমন ফেরিওয়ালাদের কাছে যেতেই হবে। যেমন তার ৫শ বা এক হাজার পোনা দরকার, সেই ফেরিওয়ালারাই তাকে গুণে গুণে ৫শ বা এক হাজার পোনা দেবেন। এভাবে ফেরিতে করে পোনার বিক্রির সুবিধা এবং অসুবিধা দুটো দিকই আছে।
আমরা এসব মাছের পোনা বিক্রি করা ফেরিওয়ালাদের পরামর্শ দেই, হাঁড়ি-পাতিল নয়, আরো বড় কোনো পাত্রে এবং সম্ভব হলে সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ সংযোজন করে এসব পোনা মাছ বিক্রি করলে ওই পোনাগুলো সুস্থ-সবল থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয় বলে জানান ওই সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০২৩
বিবিবি/এএটি