পাবনা: পাবনার সুজানগর উপজেলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণকৃত কৃষি প্রণোদনা উন্নতমানের সার ও বীজ হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট ১০ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা নিজের ও আত্মীয়-স্বজনদের নাম ব্যবহার করে এই প্রণোদনা হরিলুট করেছেন।
সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নের নির্ধারিত নীতিমালা তোয়াক্কা না করে প্রতি বছরই এভাবে হরিলুটের ফলে একদিকে যেমন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি রবি মৌসুমে ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারের নেওয়া পরিকল্পনাও হুমকির মুখে পড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, সরকার কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে সার-বীজ বিতরণ করছে এটি শুধু শুনতে পাই কিন্তু বাস্তবে কোনোদিন আমরা পাইনি। সব কিছুতো টাকা দিয়ে কিনতে হয় আমাদের। লাভ হলেও আমাদের, ক্ষতি হলেও আমাদের। শীত, বর্ষা আর শুষ্ক মৌসুমে নানা সংকট মোকাবিলা করে আমাদের ফসল ফলাতে হয়। নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধরা ভোটের জন্য আমাদের দুয়ারে দুয়ারে আসেন। আর নির্বাচনের পরে তাদের কাছে ধন্যা দিতে হয় আমাদের। কৃষকের ভালোর জন্য সরকার যা দিয়ে থাকেন সেটির সুবিধা তারাই ভোগ করেন। তবে যারা এই অনিয়ম করেছে সরকার যেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তবেই হয়তো সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে। নতুবা শুধু কাগজে কলমেই থেকে যাবে প্রণোদনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের কৃষকদের জন্য পেঁয়াজ, গম, ধান, ভুট্টা, সরিষা, মুগ ও খেসারি মোট ৭টি ফসলের উন্নতমানের বীজ ও সার বিনামূল্যে বিতরণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের পেঁয়াজের ভাণ্ডার খ্যাত এই উপজেলার জন্য উল্লেখযোগ্য শীতকালীন পেঁয়াজের বীজ। উচ্চমূল্যের বীজের আড়াই শতাধিক কৃষকদের তালিকার অধিকাংশই চেয়ারম্যান ও তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং মেম্বারদের নাম ও মোবাইল নাম্বার। দুয়েকজন কৃষকের নাম থাকলেও তারা জানেনই না এই সার-বীজ বিতরণের খবর।
কৃষি অফিসের দেওয়া পেঁয়াজের বীজের তালিকায় দেখা গেছে, উপজেলার হাটখালি ইউনিয়নে খোদ চেয়ারম্যানেরই দুটি নাম্বার, রয়েছেন চেয়ারম্যানের দুই ভাইসহ ৫-৭ জন আত্মীয়, বাকিরা ইউপি সদস্য। ভায়না ইউনিয়নের তালিকায় সবাই ইউপি সদস্য। মানিকহাট ইউনিয়নের ২৫টি প্রণোদনার মধ্যে ৪টি চেয়ারম্যান, ১টি ইউপি সচিব ও বাকিগুলো সদস্যরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এভাবে উপজেলার সব ইউনিয়নের প্রণোদনাই ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। দুই-একজন কৃষকের নাম থাকলেও তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। এই সব বীজের পরিমাণ ১ কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি পর্যন্ত। আর সার দেওয়া হয়েছে ২০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত। এইসব বীজ ও সারের মধ্যে পেঁয়াজের প্রায় ৮ লাখ, গম ১৭ লাখ টাকা, সরিষা ১১ লাখ টাকাসহ প্রায় অর্ধ কোটি টাকার প্রণোদনা রয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এই কমিটির সভাপতি, উপজেলা কৃষি অফিসার সদস্য সচিব এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এই কমিটির উপদেষ্টা। তালিকা প্রণয়ন করেন ইউপি চেয়ারম্যান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন কমিটি। কিন্তু কীভাবে তালিকাভুক্ত হয়েও এভাবে হরিলুট করা হলো সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে হাটখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ খান বলেন, তালিকা আমরাই করেছি। সে হয়তো বীজ তুলে নিয়ে এসে আরেকজনকে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো অনিয়ম করা হয়নি। তাড়াহুড়ো করে তালিকা করে দেওয়া হয় এজন্য যাচাই-বাছাই করা হয় না। এখানে আমার নাম্বারটা কীভাবে গেল আমি জানি না। আর আমার ভাইয়েরা যদি কৃষক হন তাহলে তো দোষের কিছু নেই। তারা কৃষক হিসেবে পেয়েছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, ইউপি সদস্যসহ অনেকের থেকে প্রভাবিত হয়ে তারা এইভাবে তালিকা করেছেন। এসব প্রণোদনা উপজেলা পরিষদ থেকে দেওয়া হয়, সেখান থেকেও একাধিক জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করা হয় এবং প্রণোদনা দেওয়ার সময় সেখান থেকেই রেখে দেওয়া হয়।
সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাফিউল ইসলাম বলেন, প্রথমে ইউনিয়ন থেকে তালিকাটা তৈরি করা হয়। এরপর উপজেলা কমিটি এটির চূড়ান্ত অনুমোদনের পর সার ও বীজ বিতরণ করা হয়। অনিয়মের অভিযোগ এখনও আমরা পাইনি। যদি কোনো অভিযোগ আসে তবে তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত করে দেখবো এবং প্রমাণিত হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের প্রণোদনা বিতরণ নিয়ে কথা বলেন সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, যদি সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করে থাকে অথবা তথ্য থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাইফুল আলম বলেন, মূলত সংশ্লিষ্ট উপজেলার ইউএনও মহাদয়েরা এটির দায়িত্বে থাকেন। উপজেলা পর্যায়ে কৃষি প্রণোদনার বিষয়ে আমাদের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। তবে এটি খাওয়ার জিনিস না, এটা মূলত কৃষিকাজেই ব্যবহার হবে জমিতেই যাবে। যারাই নিয়ে থাকুক সেটি নিজের জমিতেই ব্যবহার করবেন। আর এটি একটি তালিকার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। আমরা শুধু পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকি। তবে বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২২
আরএ