ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রশিক্ষণরতদের ‘জিহাদি বয়ান’ শোনাতেন আধ্যাত্মিক নেতা মহিবুল্লাহ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩
প্রশিক্ষণরতদের ‘জিহাদি বয়ান’ শোনাতেন আধ্যাত্মিক নেতা মহিবুল্লাহ

ঢাকা: নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আধ্যাত্মিক নেতা মো. মহিবুল্লাহ ওরফে ভোলার শায়েখকে (৪৮) গ্রেফতার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

এ সময় তার কাছ থেকে হতে দুটি মোবাইল এবং একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।

সিটিটিসি জানায়, মহিবুল্লাহ ক্যাম্পে অবস্থানকালে সন্ধ্যার পর প্রশিক্ষণরত সদস্যদের বয়ান দিতেন। তার বয়ানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে জঙ্গি সদস্যদের জিহাদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা।  

বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে মহিবুল্লাহ ব্যাপক নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। প্রথম দিকে হিজরতকারীদের তিনিই আশ্রয়-বয়ান দিয়ে বিভ্রান্ত করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পাহাড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ডা. শাকেরসহ অন্যান্য কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেফতারের পর গা ঢাকা দিতে রাজধানীতে অবস্থান নেন তিনি।

বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে শুরা সদস্য ডা. শাকের ওরফে শিশির, জঙ্গি নেতা শামীন মাহফুজসহ শায়েখ মহিবুল্লাহ বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যান। এ সময় ক্যাম্পে কেএনএফের তত্ত্বাবধানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলত।

সেখানে কেএনএফের প্রধান নাথান বম ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নামকরণ করা হয় এবং শুরা কমিটি গঠন করা হয়। মহিবুল্লাহকে সংগঠনটির নায়েবে আমির হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।  

সিটিটিসি প্রধান বলেন, শায়েখ মহিবুল্লাহ পাহাড়ে কিছুদিন অবস্থান করার পর ঢাকায় চলে আসেন এবং শুরা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াতের মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রম বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।

তিনি বলেন, শুরা সদস্য ডা. শাকেরকে দাওয়াতি কার্যক্রমের বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য শায়েখ মহিবুল্লাহকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংগঠনের শুরা পর্যায়ের একাধিক সদস্যের সঙ্গে ঢাকা, সিলেট ও কিশোরগঞ্জে সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একাধিক বৈঠকে অংশ নেন। এ ছাড়া তিনি হাটহাজারীসহ বিভিন্ন মাদরাসায় বিভিন্ন সময়ে আসা-যাওয়া করতেন এবং সেখান থেকে পেনড্রাইভের মাধ্যমে বিভিন্ন জিহাদি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে তার ল্যাপটপে সংরক্ষণ করতেন।  

সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জিহাদ সংক্রান্ত বিষয়ে নিজস্ব লেখার খসড়া কপিও তার কাছে পাওয়া গেছে। ডা. শাকের সিটিটিসির হাতে গ্রেফতারের পর শায়েখ মহিবুল্লাহ নিজেকে আড়াল করতে তার ব্যবহৃত সিম ও মোবাইল ফোন নষ্ট করে ফেলেন।  

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি জানান, মহিবুল্লাহ উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নায়েবে আমির হিসেবে কথিত শুরা বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তিনি ভোলার শায়েখ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পসহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন শামীন মাহফুজ।  

শায়েখ মহিববুল্লাহ চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল জামেয়াতুল আহেলিয়া দারুল উলুম মইনূল ইসলাম মাদরাসার ছাত্র থাকাকালে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদদের (হুজি-বি) সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তৎকালীন হুজির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় কথিত জিহাদি ট্রেনিং নেন।  

তৎকালীন হুজির নেতা মুফতি আব্দুর রউফ আফগানিস্তানসহ অন্যান্য জায়গায় জিহাদে যাওয়ার বিষয়ে হাটহাজারী মাদরাসা ও আশপাশের এলাকায় নিয়মিত বক্তব্য দিতেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র জিহাদের ডাক দিতেন। সে সময় হুজির অন্য জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে শায়েখ মহিবুল্লাহ যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি বিভিন্ন মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।  

প্রশাসনের নজরদারির কারণে হুজি-বির কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ায় মহিবুল্লাহ তৎকালীন হুজির সদস্যরা নতুন একটি প্ল্যাটফর্মে জিহাদি কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করেন। সেই লক্ষ্যে হুজির আরেক নেতা মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি তার সঙ্গে ২০১৭ সালে ভোলায় গিয়ে সাক্ষাত করেন।

এ সময় হুজির অন্য নেতারাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর থেকেই মাইনুল ইসলাম রক্সি ও মহিবুল্লাহর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়। ২০২১ সালে রক্সি গ্রেফতারের পর হুজির আরেক সদস্য রাকিবের সঙ্গে মহিবুল্লাহর যোগাযোগ তৈরি হয়। এরইমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার কাজে তারা সদস্য সংগ্রহ ও দাওয়াতি কার্যক্রম চালাতে থাকেন।  

এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, এই জঙ্গি সংগঠনের প্রধান ব্যক্তি শামীন মাহফুজ। তার নির্দেশে একটি কমিটি হয়। কমিটির প্রথম আমির ছিলেন রক্সি। রক্সি গ্রেপ্তারের পর আরেকজন আমির নিযুক্ত হন। শুরা কমিটির ছয়জন সদস্য ছিলেন। এর মধ্যে আনিসুল ইসলাম তমালকে নতুন আমির নিযুক্ত ও শায়েখ মহিবুল্লাহকে নায়েবে আমির নিযুক্ত করা হয়।

মূল ব্যক্তি শামীম মাহফুজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শামীন, তমাল ও রাকিব পলাতক। তাদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। রক্সিকে গ্রেফতারের সময় দায়ের করা মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ছিলেস র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার রনবীর। তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার মাধ্যমে পলাতক শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে।

শামীন মাহফুজ সম্পর্কে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ডিবি পুলিশের হাতে তিনি একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। শামীন মাহফুজ কুকি-চিন প্রধান নাথাম বমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাহাড়ি অঞ্চলে যাতায়াত ছিল শামীনের। নাথাম বমের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সপরিবারে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। তার স্ত্রী এই সংগঠনের জড়িয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গ্রেফতার শায়েখ মহিবুল্লাহকে ডেমরা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩
পিএম/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।