ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘ভাটির শার্দূল’ আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য জীবন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৩
‘ভাটির শার্দূল’ আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য জীবন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ

ঢাকা: রাষ্ট্রপতি হিসেবে টানা দুই মেয়াদ শেষে আগামীকাল বঙ্গভবন ছাড়বেন ৮০ বছর বয়সী মো. আবদুল হামিদ।

হাওরের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মো. আবদুল হামিদ ‘ভাটির শার্দূল’ নামে খ্যাত।

রসরসিকতা এবং সাদামাটা জীবন যাপনের জন্যও তার বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে।

বৈচিত্র্যময় বর্ণাঢ্য জীবনে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, আইনজীবী, ছাত্র নেতা ছিলেন।

১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ। তার পিতার নাম মরহুম হাজী মো. তায়েব উদ্দিন এবং মাতার নাম মরহুমা তমিজা খাতুন।

কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার নিকলী জি সি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন।

আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে তিনি ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন।  

১৯৬২ সালে তিনি হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরোধিতা করেন এবং ওই সময় ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে কারারুদ্ধ করে।

১৯৬২-৬৩ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ১৯৬৫-৬৬ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৬৮ সালে তিনি আবারো কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালের শেষ পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

একাত্তরের ১৭ মার্চ কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা মাঠে ছাত্র-জনতার সভায় হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সেদিন সকালেই স্বাধীনতার  ঘোষণা টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে সর্বাত্মক মুক্তি-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের আগরতলায় চলে যান। তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তারা আবদুল হামিদ তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করেন।

একইসঙ্গে তিনি আগরতলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও মত বিনিময় করেন। পরে তিনি এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশে এসে আরও কিছুসংখ্যক সহযোগীসহ মেঘালয়ের টেকেরহাট, গুমাঘাট, পানছড়া, মৈইলাম হয়ে বালাট পৌঁছান। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আগতদের জন্য তিনি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প চালু করেন এবং এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

আরও পড়ুন: ৮০ বছরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

মূলত কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ থেকে আগতদের প্রাথমিক বাছাই কাজ এখানে করা হতো। এ ছাড়া মেঘালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে গঠিত জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল-এর তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন।  

আবদুল হামিদ ভারতের মেঘালয়ে রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (মুজিব বাহিনী) এর সাব-সেক্টরের কমান্ডার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।  

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তিনি মেঘালয়ে অবস্থানকারী শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ক্যাম্পে সভা করেন। শরণার্থীদের দেশে ফেরা সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন।

স্বাধীনতার পর আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন সামরিক ও বিএনপি সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন।

তিনি ১৯৭৮ সন থেকে ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৯০ সন থেকে ১৯৯৬ সন পর্যন্ত পাঁচবার কিশোরগঞ্জ বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

আবদুল হামিদ ১৯৭০ সালে ময়মনসিংহ-১৮ থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য, ১৯৭৩ সালের ০৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে, ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ  ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচন হন।

তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৩’ দেওয়া হয়।

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ১৪ মার্চ ২০১৩ থেকে মো. আবদুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০ মার্চ ২০১৩ তারিখে রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে তিনি সেদিন থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।  

২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
 
আবদুল হামিদ ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
 
ব্যক্তিগত জীবনে আবদুল হামিদ তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক।

বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও ইতিহাস গ্রন্থ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সংবলিত পুস্তক পাঠ করা তার প্রিয় শখ।

বাংলাদেশ সময়: ০৬১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২৩
এমইউএম/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।