ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দুই দিন তিন রাত সাগরে ভেসেছিলেন তারা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
দুই দিন তিন রাত সাগরে ভেসেছিলেন তারা

ঢাকা: ২০২২ সালের অক্টোবর মাস। মাছ ধরতে আলাদা আলাদা সময়ে ভোলার চরফ্যাশন থেকে গভীর সাগরের উদ্দেশে রওনা দেয় পাঁচটি ট্রলার।

৪-৫ দিন কোনো সমস্যা ছাড়াই মাছও ধরেন তারা। কিন্তু ২৫ অক্টোবর হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে সাগর। ২০-২৫ ফুট উঁচু ঢেউয়ের তোড় সামলাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় মাঝিসহ ট্রলারের সবাইকে। এক সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় একে একে ডুবে যায় পাঁচটি ট্রলার।

ঝড়ের মধ্যে মাঝ সমুদ্রে ট্রলার হারিয়ে কেউ সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ডুবে যান, কেউবা দলছুট হয়ে হারিয়ে যান দূরে। বেঁচে যাওয়া জেলেরা যে যার মতো করে বিভিন্ন জিনিস আকড়ে ধরে ভাসতে থাকেন সাগরে। ঝড় থামার পর এভাবেই কেটে যায় দুই দিন তিন রাত। ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকেন অনেকে। বেঁচে থাকার আশা যখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, তখনই ভারতের উড়িষ্যার একটি জেলে নৌকা দেখতে পায় হতভাগ্য এই জেলেদের। পরে ভাসতে থাকা এমন ১৫ জন জেলেকে উদ্ধার করে তারা নিয়ে যান দেশটির একটি স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানে ১০ দিন চিকিৎসার পর পাঠানো হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখান থেকে ছাবেরা ফাউন্ডেশনের সহায়তায় শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) দেশে ফিরে আসেন ওই ১৫ জেলে।

শনিবার (২৯ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার বর্ণনা দেন ভারত থেকে দেশে ফিরে আসা জেলেরা। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে মাছ ধরার ট্রলার ডুবিতে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ১৫ জন জেলেকে ভারত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার বিষয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ছাবেরা ফাউন্ডেশন।

সংবাদ সম্মেলনে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার জেলে মো. দুলাল মিয়া বলেন, গত ২৫ অক্টোবর যখন সাগরে ঝড় ওঠে তখন সামনে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। আমাদের মাঝি ট্রলারটি বাঁচাতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চারদিক থেকে এমনভাবে ঢেউ আসতে থাকে যে, ট্রলার একপাশ হয়ে যায়। তারপর ট্রালারটি উল্টে আস্তে আস্তে ডুবে যায়। আমরা ট্রলারে ১৯ জন ছিলাম। ট্রলার ডোবার পর আমরা সবাই আলাদা হয়ে যাই। পরে আমরা ছয়জন একটি কলাগাছ পেয়ে সেটি ধরে ভেসে থাকি।

আমরা দুই দিন তিন রাত সাগরে ভাসতে থাকি। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। পানির পিপাসায় বুক ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। পরে ২৭ এপ্রিল রাতে ভারতের মা গঙ্গা নামের একটি জেলে নৌকা আমাদের সাগর থেকে উদ্ধার করে। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে আমাদের হাত-পা কেটে খুবই খারাপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। পরে ওই জেলে নৌকা আমাদের উড়িষ্যার একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ১০ দিন চিকিৎসার পর আমাদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে এখন আমরা দেশে ফিরে এসেছি।

দুলাল মিয়া আরও বলেন, আমাদের ট্রলারের ১৯ জনের মধ্যে মাত্র ১১ জন বেঁচে ফিরেছি। বাকিরা বেঁচে আছে কিনা জানি না।

এ দুর্ঘটনায় পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়েছেন মো. ইমাম হোসেন। নিজেও ফিরেছেন মৃত্যুর মুখ থেকে। সেই সময়ের বর্ণনা করে তিনি বলেন, ১৮ অক্টোবর বিকেলে ভোলার চরফ্যাশনের নুরাবাদ ঘাট থেকে মাছ ধরার জন্য গভীর সাগরের উদ্দেশে রওনা দেই। ২৫ অক্টোবর বিকেল ৪টার দিকে আমরা সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ি। চারদিক থেকে মনে হচ্ছে কুয়াশা ঘিরে ধরেছে আমাদের। আমরা লাইফ জ্যাকেট, গ্যাস ট্যাংকি নিয়ে বসেছিলাম। এক সময় আমাদের ট্রলার ডুবে যায়। আমরা যে যা পেয়েছি সেটা ধরে ভেসেছিলাম। আমাদের ট্রলারে মোট ২০ জন জেলে ছিল। ট্রলার ডোবার পর অনেকে ডুবে যায়, অনেকে হারিয়ে যায়। আমরা কলাগাছ পেয়ে ভেসেছিলাম। ২৭ অক্টোবর রাতে জেলেরা আমাদের উদ্ধার করে।

তিনি আরও বলেন, আমরা তিন দিন সাগরে মাছ ধরেছিলাম। এরপর ঝড়ে আমাদের ট্রলার ডুবে যায়। অনেক কষ্টে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। ডুবে যাওয়া আরেকটি ট্রলারে আমার পরিবারের পাঁচ সদস্য ছিল। তিনজন আমার বড় ভাই, একজন আমার বোনের স্বামী এবং আরেকজন আমার ভাইয়ের মেয়ের স্বামী। তারা পাঁচজনই ঝড়ে ট্রলার ডুবে মারা গেছে।

সাবেরা ফাউন্ডেশনের সভাপতি ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, গত বছরের ২৫ অক্টোবর ভোলার চরফ্যাশনের নুরাবাদ, আহমেদপুর, রচকলমী ও আবদুল্লাহ পুর ইউনিয়নের ১৫ জেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হন। ১৫টি পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়ে শোকের সাগরে ভাসতে থাকে। পরে নিখোঁজ ১৫ জেলেকে সাগর থেকে উদ্ধার করে ভারতের একটি জেলে নৌকা। তাদের চিকিৎসা শেষে রাখা হয় আশ্রয়কেন্দ্রে।

মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ঘটনাটি জানার পর আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় ১৫ জেলেকে ভারতের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি। শুক্রবার তারা দেশে ফিরে আসেন।

তিনি আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সেই সময় ৫টি ট্রলার সাগরে ডুবে যায়। এতে ১০০ জনের মতো নিখোঁজ হন। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে নিখোঁজ আছেন। আমরা নিখোঁজদের সন্ধান করছি। ভারত থেকে ১৫ জনকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আরও ৩ জন সেখানে আছেন। তাদের ১০-১৫ দিনের মধ্যে নিয়ে আশার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিতি ছিলেন ছাবেরা ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মেজবা উদ্দিন টিপু, সদস্য মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার সভাপতি ইয়াসিন মোহাম্মদ প্রমুখ।

ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা ১৫ জেলে হলেন—ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মো. মনির হোসেন, মো. ইমাম হোসেন, আব্দুল হক, মো. গিয়াস উদ্দিন, মো. ইউসুফ, মো. নুর নবী, মো. রাজিব, মো. কাল্লু, মো. ফিরোজ, মো. বেলাল, মো. আমজাদ হোসেন, মো. দুলাল মিয়া, ইকবাল মিয়াজি, ইমাম হোসেন, মো মুরাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, এপিল ২৯, ২০২৩
এসসি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।