বরিশাল: নদী ও সাগর বেষ্টিত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ মানুষের পেশা মাছ ধরা। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অনেকের আবার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যমও এটি।
সাধারণত নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা অধিক লাভজনক। তাই জেলেরা দলে দলে ছুটে চলে উত্তাল সাগরের বুকে। তবে সাগরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে তাদের নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় তাদের। প্রায়ই জেলে নৌকাগুলো জল-দস্যুদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরতে হয়। প্রাণও যায় অনেকের।
তবে জল-দস্যুদের থেকেও ভয়ঙ্কর হচ্ছে সাগরের বৈরি আবহাওয়া। সাগরে যাওয়া জেলেদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় এটি। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ নানা বৈরি আবহাওয়া কারণে প্রাণ যায় অসংখ্য জেলের।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত সাত বছরে শুধু বরিশাল বিভাগেই বৈরি আবহাওয়ার কারণে সমুদ্রগামী ৬০৯টি জেলে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। যেখানে এক হাজার ১০৬ জন জেলে হতাহত, ২৫৯ জন জেলের মৃত্যু এবং ১৭২ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
তথ্যানুযায়ী, ওই সাত বছরে সবথেকে বেশি ১৫১টি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে, এরআগে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ ১০৭টি এবং ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন ৪৬টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।
আর ২০১৬ সালে ৮৫টি নৌকাডুবির ঘটনায় সর্বোচ্চ ৭৭ জন জেলের মৃত্যু হলেও ২০২২ সালে সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫১টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৮ জন জেলের মৃত্যু হয়েছে। তবে ২০১৭ সালে নৌকাডুবির পাশাপাশি সর্বনিম্ন জেলের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর ১২ জন জেলের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০১৮ সালে ১৮ জন, ২০১৯ সালে ৩৮ জন, ২০২০ সালে ৫৭ জন এবং ২০২১ সালে ৩৯ জন জেলের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, তালিকায় সর্বোচ্চ ৬২ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছে ২০১৮ সালে, আর সর্বনিম্ন জেলে নিখোঁজ হয়েছে ২০১৭ সালে। এরআগে ২০১৬ সালে নিখোঁজ হয় ১০ জন জেলে। তবে ২০১৮ সালের পর ২০১৯ সালে ২২ জন, ২০২০ সালে ১৩ জন, ২০২১ সালে ১১ জন এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ৪৭ জন জেলে নিখোঁজ হন।
সরকারের পক্ষ থেকে সমুদ্র নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে জানিয়ে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, সাগরে নৌ-বাহিনী ও কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল ও নজরদারি রয়েছে। ফলে আগের থেকে জল-দস্যুদের উপদ্রব কম। এছাড়া মাছ আহরণকালে আবহাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মৃত ও নিখোঁজ জেলেদের পরিবারের পাশে সরকার সবসময় আছে। মৎস্য বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ের নিষেধাজ্ঞায় খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।
এদিকে, সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের বরিশালের সদ্য বিদায়ী উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি জেলেদের সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে জেলেদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা কি কি সঙ্গে নিয়ে যাবে, কি করবে, এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে জেলেদের করণীয় বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে অতীতের থেকে জেলেদের অনেকটাই সচেতন করা গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় বরিশাল বিভাগের চার হাজার ১০০ ফিশিং বোটের মধ্যে তিন হাজার ৯০০ বোটে গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন (জিএসএম) ডিভাইস লাগানো হয়েছে। ফলে জেলেরা কোথায় আছে সেটি এখন মুহূর্তেই জানা সম্ভব হচ্ছে। সেই সঙ্গে এরইমধ্যে লাইট আর টেম্পারেচার রিকগনাইজেশ ডিভাইস থাকায় আগাম ঘূর্ণিঝড়ের আগে সৃষ্ট তাপমাত্রা পরিবর্তনের বিষয়টিও জানতে পারছেন তারা। ফলে আগাম সতর্ক হয়ে নিরাপদে চলে আসতে পারছেন জেলেরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
এমএস/এসআইএ