ঢাকা: স্থানীয় সরকার (এলজিআরডি), পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের পাশাপাশি নাগরিকদের ও সচেতনতা জরুরি। এজন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (৪ মে) 'বারবার অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ প্রতিরোধে করণীয়' শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এই নাগরিক সংলাপের আয়োজন করে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম।
এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে অবকাঠামো নির্মাণে সব আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করার বিকল্প নেই। সেজন্য একটি এলাকায় পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বসবাসযোগ্য ঢাকা নির্মাণে করতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার কারণে ঢাকা শহর দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, একটি বিল্ডিং বা মার্কেট নির্মাণের সময় বিশেষজ্ঞ হিসেবে আর্কিটেক্ট থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার সবাই পরিকল্পনা করে অবকাঠামো নির্মাণ করেন। নির্মাণের সময় যদি সঠিক নিয়ম মেনে অবকাঠামো নির্মাণ করা না হয় তাহলে সেখানে অগ্নি ঝুঁকি থাকবেই।
তিনি আরো বলেন, অবকাঠামো নির্মাণে কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট বা ভবনের মালিক যার অবহেলায় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটবে তাকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে শুধু ভবন মালিককে জেলে নেওয়া হয়। অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে নিয়মিত মহড়া এবং প্রশিক্ষণের পরামর্শ দেন তিনি।
এ সময় তিনি সিগারেটের আগুন থেকে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেন। আগুনে পুড়ে জানমাল সবকিছু বিনষ্ট হওয়ার পরে আফসোস করা থেকে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রথম থেকেই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, রাজউক এখন আর্কিটেকচারাল প্ল্যান ছাড়া আর কোনো প্ল্যান জমা নেয় না। কিন্তু বিএমডিসি অনুযায়ী, আর্কিটেকচারাল প্ল্যান, স্ট্যাকচারাল প্ল্যান, ফায়ার সেফটি প্ল্যান, ইলেক্ট্রিক্যাল প্ল্যান এবং প্ল্যাম্বিং প্ল্যান সবই জমা দিতে হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী ১ জুন থেকে সকল বিল্ডিংয়ের প্ল্যান জমা দেওয়ার সময় এসবই জমা দিতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে জলাধার সংরক্ষণে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে। কিন্তু আমরা বুড়িগঙ্গাকে পুনরুদ্ধারে কাজ করছি। এটি একটি জলাধার হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া মান্ডা, ধোলাইসহ ঢাকার বিভিন্ন খাল পরিষ্কার করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অসাবধানতাই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ। মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স বা বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম ঠিকমতো রাখা হয় না।
তিনি আরো বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীরা মার্কেটে ১০০ দোকানের অনুমোদন নিয়ে ২০০দোকান করেন। এতে ভবন তৈরিতে যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর ওপর চাপ বাড়ে। মানুষের চলাচলের পথও সংকীর্ণ হয়ে যায়। নিয়ম না মেনে গোডাউনে পণ্য মজুদ করেন। এতে আগুন লাগলে নেভাতে অনেক সময় লেগে যায়। যেটা হয়েছিল বঙ্গবাজারের ক্ষেত্রে।
তিনি আরো বলেন, ফায়ার সার্ভিস সার্ভে করে একবার এক হাজার ১৯১ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। এখন আবার সেসব ভবনের ৫৮টিতে সার্ভে করতে গিয়ে দেখা গেছে, ৩৫ টিই অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
তদারকি সংস্থাগুলোর মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, ঢাকা ওয়াসার ১০টি জোনে ৪৫টি ওয়াটার হাইড্রেন্ট আছে। যেগুলো থেকে ওয়াসার গাড়িতে পানি সরবরাহ করা হয়। ৯০০টি ডিপ টিউবয়েলের মধ্যে ৫০০টিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট লাগানো আছে। যেখান থেকে ফায়ার সার্ভিস পানি নিতে পারে। এছাড়া সিটি হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা আমরা করছি। কিন্তু আপাতত আমাদের পানির প্রেসার না থাকায় পুরোপুরি ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে আমরা এর বিকল্পও ভাবছি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, আমরা ভবনগুলো এমনভাবে তৈরি করি যে, জায়গা থাকে না। গ্যাস লিকেজ হয়ে সেগুলো জমা হয় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। এখানে আমাদের অংশীদারদের এবং বাসিন্দাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমাদের ভবন নির্মাণের সময় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, ভবন কাঠামো, অগ্নিঝুঁকি ও নকশা মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে আমাদের জলাধার সংরক্ষণ প্রয়োজন।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মো. রাজু আহমেদ বলেন, আমাদের দেশের অগ্নিদুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা বৈদ্যুতিক সামগ্রী। কারণ আমাদের ভবন নির্মাণের সময় যারা বৈদ্যুতিক কাজ করেন তাদের জ্ঞান কম। তারা দেখে কাজ শেখেন। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়া আমারা যেসব বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করি সেগুলোর মান কম। যার কারণে শর্ট সার্কিটের মতো ঘটনা ঘটছে এবং অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে।
নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি অমিতোষ পালের সভাপতিত্বে নগর সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৫ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০২৩
এসসি/এসআইএস