ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শরীয়তপুরে ২ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট     | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২৩
শরীয়তপুরে ২ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশ

শরীয়তপুর: শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া সার্কেল) রাসেল মনির ও সদ্য প্রত্যাহার হওয়া পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পুলিশ সুপারকে (এসপি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।  

জাজিরার পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার একটি ছিনতাই মামলার আসামিদের শারীরিক নির্যাতন করে আহত করার ঘটনায় শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান ০৭ জুন এ আদেশে সই করেন।

রোববার (১১ জুন) আদালত পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ওই আদেশের কপি পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী ০৯ জুলাইয়ের মধ্যে ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩ -এর ৫ ধারা অনুযায়ী ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিকেলে শরীয়তপুরের আদালত পরিদর্শক মেজবাহ্ উদ্দিন আহম্মেদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, আসামিদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আমলি আদালত থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে, জেলা এসপি এ বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ০৯ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।  

ভুক্তভোগীরা ও তাদের বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু জেলা এসপি বরাবর লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মোহাম্মদ বদিউজ্জামানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।  

জানা গেছে, গত ২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদারকান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হন। জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে তারা এ মামলার আরেক আসামি আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান। ওইদিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০-১২ পুলিশ সদস্য।  

অভিযোগে বলা হয়, এ সময় সাদ্দাম তাদের জামিনের কাগজ দেখালে তা ছিঁড়ে ফেলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। পরে পুলিশ সাদ্দাম ও বকুলকে লাথি, কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়সহ পুলিশের লাঠি (ডান্ডা), কাঠ, হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। একপর্যায়ে প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। সাদ্দাম পানি পান করতে চাইলে ছোট ভাই বকুলকে দাঁড় করিয়ে মুখে প্রস্রাব করতে বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির। পরে সাদ্দামের শরীরে প্রস্রাব করেন বকুল। এমন নির্যাতন চলে রাত ১টা থেকে পরদিন ৩১ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত।

জানা যায়, কিছুক্ষণ পর ওই চারজনকে গামছা ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর নিচে আনা হয়। পরে সাদ্দাম ও বকুল এবং সাইদুল ও আনোয়ারকে আলাদা দুই স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।  

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি সাদ্দাম-বকুলকে বলেন, সাইদুল-আনোয়ারকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিয়েছি। তোরা ৭২ লাখ টাকা দিবি, তা না হলে তোদেরও ক্রসফায়ার দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে সারাদিন রেখে রাতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় এনে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে বেত ও কাঠ, কোদালের বাট, লাঠি দিয়ে আবার বেধড়ক মারধর করা হয় সাদ্দাম ও বকুলকে। সারা রাত চলে এ নির্যাতন। এরপর টাকার জন্য বকুলের স্ত্রী সানজিদা, দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ চোকদার, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারা রাত আটকে রাখা হয় এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়।  

অভিযোগে জানা গেছে, পরে আত্মীয়-স্বজনরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসির কাছে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকা দিলে নির্যাতন থেকে মুক্তি মেলে সাদ্দাম ও বকুলের। এ দুদিন যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও তাদের খাবার ও ওষুধ দেননি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি।

অভিযোগকারীরা জানান, গত ০১ জুন বিকেলে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনকে শরীয়তপুর আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রিমান্ড না মঞ্জুর করেন। পরে ৬ জুন বিকেলে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনই আদালত থেকে জামিন পান।  

ছিনতাইয়ের মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মে দুপুরে পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সোহাগ পরিবহন থেকে জাজিরা উপজেলার বাসিন্দা শাহীন আলম শেখ (২০) ও সেকেন্দার মাদবরকে (৫১) জোর করে নামিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা বিদেশি ডলার, মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায় স্থানীয় সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ১০-১১ জন। ডলারসহ যার আনুমানিক মূল্য ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা ধরা হয়েছে। এ ঘটনায় ২৩ মে শাহীন আলম শেখ বাদী হয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় সাদ্দাম, বকুলসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জনকে আসামি করে একটি ছিনতাই মামলা করেন। তবে শাহীন আলম ও সাদ্দাম চোকদারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শত্রুতা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

                         নির্যাতনের শিকার বকুল চোকদার ও সাদ্দাম চোকদার (বাঁ থেকে) / ছবি: সংগৃহীত

মেডিকেল প্রতিবেদনের বিষয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুমন কুমার পোদ্দার বলেন, গত ৪ জুন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান চার আসামিকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ আঘাতগুলো কীভাবে করা হয়েছে, তা বলতে পারবেন না। মেডিকেল প্রতিবেদনে নির্যাতনের সত্যতা পেয়ে শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান তা আদালতে নথিভুক্ত করেন। এরপর তিনি ৭ জুন এ বিষয়ে আদেশ দেন। ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩’–এর ৫ ধারার বিধান অনুযায়ী অভিযুক্ত নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর ৯ জুলাইয়ের মধ্য আমলি আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ সুপার শরীয়তপুরকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাজিরার আহাদী বয়াতিকান্দি গ্রামের শাহীন আলম শেখ ও তার সহযোগী ছোট কৃষ্ণনগর গ্রামের সেকান্দার মাদবরের কাছ থেকে গত ২১ মে ১৭ হাজার ডলার, টাকা ও মোবাইলফোন ছিনতাই হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তাতে ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা খোয়া গেছে এমন অভিযোগ এনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় মামলা করেন শাহীন আলম। এতে বকুল চোকদার, সাদ্দাম চোকদার, সাইদুল শেখ, আনোয়ার হোসেনসহ ৯ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ২৯ মে তারা উচ্চ আদালত থেকে ৬ সপ্তাহের জামিন পান। এরপর রাতে তারা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাসায় ছিলেন। সেখানে তাদের ওপর চড়াও হন জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারী ও ছিনতাই মামলার বাদীর আত্মীয় শহীদুল ইসলাম। পরে রুবেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি শেখ মোস্তাফিজুর রহমানকে ফোনে কেরানীগঞ্জের ওই বাসায় ডেকে নেন। সেখানে একটি কক্ষে আটকে তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

এ ব্যাপারে জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারী বলেন, যার ডলার ও টাকা ছিনতাই হয়েছে, তিনি তার ভাগনে হয়। তাকে সহযোগিতা করার জন্য সামাজিকভাবে তিনি মামলার আসামিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। ঢাকায় তাদের অনুসরণ করে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন। তখন ধস্তাধস্তিতে তারা ব্যথা পেতে পারেন।

আদালত পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আমলি আদালত থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। ওই আদেশের নথি বৃহস্পতিবার শেষবেলায় আমাদের কাছে পৌঁছায়। শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকায় তা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠাতে পারিনি। আজ (রোববার) সকালে পাঠিয়েছি। ওই আদেশে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ভুক্তভোগী সাদ্দাম চোকদার বলেন, আমাদের চোখ বেঁধে আটকে রেখে দু’দিন ধরে মারধর করা হয়। হাতুড়ি দিয়ে হাড় ও হাত-পায়ে পেটানো হয়। প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে দেওয়া হয়েছে। আমার বাঁ চোখে লাথি মেরেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির।  

অপর বকুল চোকদার বলেন, আমাদের পিটিয়েছে আর জিজ্ঞেস করেছে- টাকা কোথায় রেখেছিস? তোদের ৭২ লাখ টাকা দিতে হবে, তোরা টাকা নিয়েছিস, তা স্বীকার কর। চোখ বেঁধে দু’জনকে আলাদা করে ফেলেছিল। দু’জনকে এনকাউন্টারে দেওয়া হয়েছে বলে ভয় দেখানো হয়েছে। আমার চাচাতো ভাই সাদ্দামকে মেরে ফ্লোরে ফেলে রাখার পর সে পানি খেতে চেয়েছিল। তখন আমাকে ভাইয়ের মুখে প্রস্রাব করে দিতে বলে। আমি কান্না শুরু করলে আবার পেটায়। বাধ্য হয়ে ভাইয়ের শরীরে প্রস্রাব করি।

এ ঘটনায় অভিযুক্ত শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া সার্কেল) রাসেল মনির ও সদ্য প্রত্যাহারকৃত পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্যের জন্য বারবার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।  

এ ব্যাপারে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল হক বলেন, এসব ঘটনা আমরা তদন্ত করছি। অভিযোগের বিষয় প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আদালত থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশনা আমার দপ্তরে পৌঁছায়নি। আদালত কোনো নির্দেশনা দিলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

** ৭২ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার-ওসির বিরুদ্ধে

বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২৩
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।