সাতক্ষীরা: ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার হয়নি সাতক্ষীরার দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা স. ম আলাউদ্দীন হত্যা মামলার। ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন রাতে নিজ পত্রিকা অফিসে কর্মরত অবস্থায় ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন তিনি।
আজও এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিচারের আশায় উন্মুখ হয়ে আছে তার পরিবার, সাতক্ষীরাবাসী।
সূত্র মতে, ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন সাতক্ষীরা সদর থানার প্রাচীর সংলগ্ন দৈনিক পত্রদূত এর তৎকালীন অফিসে কর্মরত অবস্থায় ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারান আধুনিক সাতক্ষীরার স্বপ্নদ্রষ্টা স. ম আলাউদ্দীন।
এ ঘটনায় নিহতের ভাই স. ম নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ৬ মে সিআইডির খুলনা জোনের এএসপি খন্দকার ইকবাল হোসেন এ হত্যা মামলায় সাতক্ষীরার চিহ্নিত সন্ত্রাসী গডফাদারসহ ১০ জনের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
এ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরের গোলাম খায়বার সরদারের ছেলে সাইফুল ইসলাম ওরফে কিসলু, তার দুই ভাই মো. খলিলুল্লাহ ওরফে ঝড় ও মোমিনউল্লা মোহন, আলিপুরের আব্দুস ছাত্তারের ছেলে আব্দুস সবুর, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের নাটয়াররড গ্রামের গোপাল রহমানের ছেলে আতিয়ার রহমান, শহরের সুলতানপুরের মৃত কাজী আব্দুল ওহাবের ছেলে কাজী সাইফুল ইসলাম, তালার নগরঘাটার মৃত শামসুদ্দিন সরদারের ছেলে মো. আব্দুর রউফ, সাতক্ষীরা শহরের প্রাণ সায়র এলাকার মৃত তোফাজদ্দিন সরদারের ছেলে শফিউর রহমান, শহরের সুলতানপুরের মৃত শেখ নুরুল ইসলামের ছেলে এস্কেন ও শহরের কামালনগরের মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে কালাম।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার প্রভাবশালী আসামি আব্দুস সবুর ও খলিলুল্লাহ ঝড়সহ কয়েকজন ১৯৯৯ সালের ২৬ জুলাই সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত তাদের আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসামিদের আজ্ঞাবহ সন্ত্রাসীরা সাতক্ষীরা আদালত ঘেরাও করে এবং সাতক্ষীরা জজ কোর্টের সব বিচারককে ৬ ঘণ্টা জিম্মি করে রাখে।
পরবর্তীকালে আসামি আব্দুস সবুর ও খলিলুল্লাহ ঝড়সহ ওই আসামিরা হাইকোর্টে কোয়াশমেন্ট করে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আ্যাপিলেট ডিভিশন ওই আদেশ খারিজ করেন। পরে আসামি আব্দুস সবুর, খলিলুল্লাহ ঝড়সহ আসামিরা সাতক্ষীরার কোনো আদালতে এই মামলার ন্যায় বিচার পাবেন না উল্লেখ করে অন্য কোনো জেলায় মামলাটি স্থানান্তরের আবেদন জানালে বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়। হাইকোর্টও পরে অ্যাপিলেট ডিভিশনে ওই আবেদন নামঞ্জুর হলে দীর্ঘ ১৫ বছর পর ২০১১ সালে সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শুরু হয় এবং প্রায় ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
একপর্যায়ে ২০১৮ সালের শেষের দিকে মামলার তৎকালীন সংশ্লিষ্ট বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বাদী পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির বিচার কার্যক্রম পুনরায় ৬ মাসের জন্য স্থগিত হয়। ইতোমধ্যে সে স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হলেও অজ্ঞাত কারণে বিচার কার্যক্রম আর শুরু হয়নি।
উল্লেখ্য, স. ম আলাউদ্দীন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত ১০জন আসামির মধ্যে অন্য একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ও অসংখ্য মামলার আসামি সাইফুল্লা কিসলু ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার ম্যানেজার আতিয়ার রহমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এখনো পলাতক রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কাটা রাইফেলসহ গ্রেপ্তারকৃত আসামি সাইফুল ইসলাম যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় জামিনে মুক্ত রয়েছেন। অপর আসামি আব্দুর রউফও একটি হত্যা মামলায় সাজা খেটে কয়েক বছর আগে জেল থেকে বের হয়েছেন। আসামি এসকেন পালিয়ে বিদেশে চলে গেলেও কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে এই হত্যা মামলায় কয়েকদিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। অপর একটি হত্যা মামলায় সাজা খেটে বর্তমানে এই হত্যা মামলায় জামিনে রয়েছেন আসামি শফিউল ইসলাম। তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আবুল কালাম, মোমিন উল্লাহ মোহন, শীর্ষ সন্ত্রাসী গডফাদার হিসেবে পরিচিত আব্দুস সবুর ও খলিলউল্লাহ ঝড় জামিনে রয়েছেন।
বিচারের বাণী কাঁদছে নীরবে নিভৃতে!
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাড. আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, স. ম আলাউদ্দীন শুধু একজন পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন না, তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। তাকে হত্যার মধ্যদিয়ে সাতক্ষীরার উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে অন্তত ৩০ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। স. ম আলাউদ্দীন হত্যা মামলার বিচার না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী স. ম আলাউদ্দীন সাতক্ষীরার তালার উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি গ্রামে ১৯৪৫ সালের ২৯ আগস্ট (বাংলা ১৩৫২ সালের ১৫ ভাদ্র) জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৬২ সালে হামাদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৬৫-৬৮ পর্যন্ত খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় আন্দোলন সংগ্রামের কারণে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও একাধিক কলেজ থেকে ফোর্সটিসি দেওয়ায় তার শিক্ষা জীবন বিঘ্নিত হয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে খুলনা ল’ কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তার নেতৃত্বে তালা থানা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয় এবং তিনি কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৭ সালে বি এ পাশ করে তালার জালালপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করলেও রাজনীতির প্রতিটি কর্মকাণ্ডে দক্ষ সংগঠক হিসেবে জানান দেন স. ম আলাউদ্দীন। ৬৯-৭০’র উত্তাল গণআন্দোলনে স . ম আলাউদ্দীন ছিলেন সাতক্ষীরার তরুণ আন্দোলনকারীদের প্রাণ পুরুষ। উত্তপ্ত রাজপথের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুর্জয় তরুণ আলাউদ্দীন ওই সময়ই সাতক্ষীরার গণমানুষের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সর্বকনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে অংশগ্রহণকারী সংসদ সদস্যদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকেরও ভূমিকা পালন করেন। এসময় নির্বাচিত এমপি হয়েও তিনি কমিশন্ড অফিসার হিসাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং কিছুদিন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের পর সাতক্ষীরা মহাকুমা মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পান।
পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন সাইফুল্লাহ নাম গ্রহণ করে দেশে প্রবেশ করে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি খুলনা জেলা মুজিব বাহিনীরও সংগঠক ছিলেন এবং এসময় তার নির্বাচনী এলাকায় মুজিব বাহিনীর প্রধান দপ্তর ছিল। স. ম আলাউদ্দীনের ব্যক্তিগত সদ্ভাব ও সমন্বয়ের কারণে খুলনা জেলার কোথাও এই দুই বাহিনীর মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানের কারণে তিনি কমপক্ষে চার বার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেও পাকিস্তানের সামরিক আদালত তাকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, সংসদ সদস্যপদ বাতিল, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয় এবং তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে এলাকায় মাইকিং করে।
সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অবলম্বন করে কলকাতার উমাপ্রসাদ মৈত্র পরিচালিত ‘জয়বাংলা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন স.ম আলাউদ্দীন।
১৯৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন সামরিক সরকারের নিবর্তনমূলক আইনে স. ম আলাউদ্দীন গ্রেপ্তার হন। ছয় মাস কারাভোগ শেষে মুক্তির তিন মাস পর তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন। ১৯৮৩ সালে স. ম আলাউদ্দীন সাতক্ষীরা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, ভোমরা স্থলবন্দর ব্যবহারকারী সমিতির সভাপতি, সাতক্ষীরা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের সভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নব্বই এর দশকের শুরুতে দেশব্যাপী মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি কর্মমুখী শিক্ষার নিজস্ব ভাবনা থেকে সাতক্ষীরাতে প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে ‘বঙ্গবন্ধু পেশাভিত্তিক স্কুল ও কলেজ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন।
এদিকে দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক, সাবেক এমসিএ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক স. ম আলাউদ্দীনের ২৮তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আলোচনা সভা, মরহুমের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন, কোরআন খানি ও দোয়া অনুষ্ঠান।
এছাড়া আগামী ৮ জুলাই স. ম আলাউদ্দীনের ২৮তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে সাতক্ষীরায় মুক্তিযোদ্ধা-প্রজন্ম সমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০২৩
আরএ