ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

স্বপ্নের ইতালি যাওয়ার পথে বন্দী লিবিয়ায়, পরিবার নিঃস্ব

ইমতিয়াজ আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২৩
স্বপ্নের ইতালি যাওয়ার পথে বন্দী লিবিয়ায়, পরিবার নিঃস্ব সাগর পথে ইতালি যাওয়ার পথে প্রাণ হারান কেউ কেউ, বন্দী হন অনেকে, প্রতীকী ছবি

মাদারীপুর: স্বপ্নের দেশ ইতালি। আর্থিক স্বচ্ছলতা আর আধুনিক জীবনযাপনের আশায় জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ মনে করে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছিলেন মাদারীপুরের অসংখ্য যুবক।

কিন্তু প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যের লিবিয়ায় বন্দী দিন কাটছে তাদের।  

ইতালি তো দূরে থাক, লিবিয়ায় বন্দী থেকে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দেশে ফিরতে চাইলেও অসংখ্য যুবক ফিরতে পারছেন না। এসব যুবককে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে সর্বস্বান্ত  হয়ে গেছে দেশে থাকা পরিবারগুলো। এরপরও মুক্তি নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটছে বন্দী যুবক ও দেশে থাকা স্বজনদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উৎরাইল এলাকার বেলায়েত শেখের ছেলে স্বপন। ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়লেও দীর্ঘদিন ধরে বন্দী রয়েছেন লিবিয়াতে। সহ্য করতে হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। দেশে ফিরিয়ে আনতে দফায় দফায় তার পরিবার ব্যয় করেছেন ২০ লক্ষাধিক টাকা। তবু এখনো ফিরতে পারেননি দেশে। তবে শিগগিরই দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে পরিবারের আশা। ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন উবে গেছে, প্রাণ নিয়ে দেশ ফিরতে পারলেই স্বস্তি।

মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের খাগদাহ গ্রামের আতাহার খানের ছেলে রবিন খান (২২)। এক বছর আগে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়েন। এরপর দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন লিবিয়ার দালালদের কাছে। কয়েক দফায় মারধর ও হত্যার হুমকি দেওয়া হয় তাকে। পরে জমি বিক্রি করে তার পরিবার ১৭ লাখ টাকা দেয় দালালদের। চলতি বছরের ২২ আগস্ট থেকে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। মা-বাবা জানেন না, রবিন বেঁচে আছেন কি না।  

মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়ারচর গ্রামের আমজাদ বেপারীর ছেলে আজীম বেপারীর (২২) সঙ্গে তিন মাস আগে পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ হয়। এরপর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এর আগে আমির নামে এক দালাল কয়েক দফায় ১৮ লাখ টাকা নেন ইতালি পাঠানোর নামে।  

আজীমের বাবা আমজাদ বেপারী বলেন, ভিটামাটি বিক্রি করে ছেলের জন্য ১৮ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আমরা নিঃস্ব। ছেলে কোথায় তাও জানি না।

একই এলাকার ইউনুস মোল্লার ছেলে রানা মোল্লা ইতালির উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। এরপর তার ঠাঁই হয় লিবিয়ার বন্দীশালায়। সেখানে আটকে রেখে চালানো হয় নির্যাতন। দালাল চক্র কয়েক দফায় আদায় করে ২২ লাখ টাকা। পরে দালালদের টাকা দিয়ে চলে আসেন দেশে।  

নির্যাতনের শিকার রানা জানান, দালালরা হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে। নির্যাতনের সময় কান্নার আওয়াজ রেকর্ড করে পরে সে রেকর্ড শুনিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আদায় করা হয় টাকা।

এদিকে মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য পেয়ারপুর গ্রামের তরিকুল ও রুবেল নিখোঁজ রয়েছেন চার বছর ধরে। পরিবারের সঙ্গে নেই কোনো যোগাযোগ। বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, তাও জানেন না পরিবারের সদস্যরা।  

মাদারীপুর জেলার সদর, রাজৈর, শিবচরসহ বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য যুবকের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে দালালদের খপ্পরে পড়ে। সন্তানকে বাঁচাতে টাকা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। কেউ কেউ লাশ হয়ে ফিরেছেন দেশে, কেউ এখনো নিখোঁজ।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দালালরা লিবিয়ায় নিয়ে টাকা আদায় করতে অমানবিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। একাধিক মাফিয়া চক্রের হাতে হাত বদল হচ্ছে দফায় দফায়।

নিখোঁজ রবিন খানের বাবা আতাহার খান বলেন, দালালদের চাহিদামতো টাকা দিতে না পারলে লিবিয়ার বিভিন্ন টর্চার সেলে শারীরিক নির্যাতন করে তুলে দেয় লিবিয়ান মাফিয়াদের হাতে। মাফিয়ারা নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে এবং হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে এ দেশে দালালদের মাধ্যমে এসব পরিবারের কাছ থেকে আদায় করছে লাখ লাখ টাকা। আমরা এর বিচার চাই।

এদিকে এসব ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা হয় না। দু-একটি মামলা হলেও দালালরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না। জেলার সদর, শিবচর, রাজৈর, টেকেরহাট এলাকায় প্রায় দেড় ডজন দালাল রয়েছে। যারা নানা প্রলোভনে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করছে।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান, মানবপাচারের অভিযোগে এর আগে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাছাড়া অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।