ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

পর্ব -১

কৃষি তথ্য সার্ভিসে বেপরোয়া সিন্ডিকেট, লুটে নিচ্ছে কোটি টাকা

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪
কৃষি তথ্য সার্ভিসে বেপরোয়া সিন্ডিকেট, লুটে নিচ্ছে কোটি টাকা

ঢাকা: রাজধানীর ফার্মগেটের খামারবাড়িতে অবস্থিত কৃষি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)। গণমাধ্যমের সাহায্যে কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকের কাছে পৌঁছানোই এ সংস্থার মূল লক্ষ্য।

কিন্তু সেখানে কাজ হয় ভিন্ন।  

বিভিন্ন প্রকল্প, প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অপকর্মের মাধ্যমে এ সংস্থার অর্থ লোপাটের অভিযোগ মিলেছে বড় দুই কর্মকর্তা বিরুদ্ধে। এ দুজন হলেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় ও প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস।

এআইএসেরই একাধিক সূত্র বলছে, এ দুজন শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এআইএসের গুটিকয়েক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এ সিন্ডিকেটের সদস্য। এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট সংক্রান্ত অভিযোগের অনেক নথির কপি বাংলানিউজের হাতে রয়েছে।

জানা গেছে, খামারবাড়ির সদর দপ্তরসহ দেশব্যাপী ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সেবা দিয়ে থাকে এআইএস। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কৃষি উন্নয়নমূলক প্রচার-প্রচারণা; মন্ত্রণালয় ও এর বিভিন্ন সংস্থার চাহিদা অনুসারে মুদ্রণ সামগ্রী প্রকাশ, ভিডিও নির্মাণ ও প্রচার করে সংস্থাটি। এসবকে পুঁজি করেই সিন্ডিকেটটি দুর্নীতির ‘খোলা খাতা’ খুলে বসেছে।

এআইএসের নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে সুরজিত ও ফেরদৌসের সিন্ডিকেটে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক ও ক্যাশিয়ার মো. জুয়েল হোসেন সরাসরি জড়িত। তাদের ডান হাত- বাঁ হাত রয়েছে। সবাই মিলে ভুয়া বিল, ভাউচার ও কোটেশনের (বিতরণ না করেই) মাধ্যমে কয়েকটি সরবরাহকারী বা কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ ওই সূত্রের।

এআইএসের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কৃষি তথ্য সার্ভিস পরিচালক অনেক সময় ব্যবহার করেন কৃষি সচিবের নাম। কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলে হতে হয় বদলি; কোনো কোনো সময় হতে হয় হয়রানির শিকার।

অভিযোগ আছে, সুরজিতের চালিত সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। মানসিক হয়রানিও করেন কেউ কেউ। সিন্ডিকেটের বাইরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি নিয়েও নানা রকম হয়রানি করা হয়। কেউ ছুটিতে গেলে তাদের ফোনে কল করেও খারাপ ব্যবহার করেন সিন্ডিকেট সদস্যরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এআইএসের এক নারী কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, সংস্থার কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব বিষয়ে চিহ্নিত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গুরুত্ব দেন পরিচালক। ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাত ১০টা পর্যন্ত তার কক্ষে অবাধে যাতায়াত করেন। এতে তিনিসহ অন্যান্যরা বিব্রত বোধ করেন। পরিচালক সুরজিত কথায় কথায় ‘কৃষি সচিব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে তাদের হুমকি দেন। ছোট কোনো ঘটনা ঘটলেই ‘কৃষি সচিবকে জানিয়েছি’ বলে তিনি সবাইকে আতঙ্কে রাখেন।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় ও প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস (বাঁ থেকে)কোটেশনের মাধ্যমে অর্থ লোপাট

জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কোড (৩২১১১২৮) দেখিয়ে প্রকাশনা (কাগজ ও কালি ক্রয়) খাতে ১ কোটি ৫০ লাখ; কম্পিউটার সামগ্রী (কোড ৩২৫৫১০১) ১২ লাখ ৫৭ হাজার, ব্যবহার্য সামগ্রী (৩২৫৬১০৩) ১০ লাখ, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম (৩২৫৮১০৫) ৩০ লাখ, অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা (৩২৫৮১০৮) ১০ লাখ, আইসিটি ও সফটওয়্যার (৪১১৩৩০১) ১৫ লাখ ২০ হাজার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি (৪১১২৩০৩) বাবদ ১৫ লাখ টাকাসহ অন্যান্য কোডের মাধ্যমে প্রায় ৩ কোটি টাকা পিপিআর-২০০৮-এর তফসিল ধারা অনুযায়ী সরকারি বিধান মতে কোনো প্রকার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে লোপাট করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কৌশল ছিল তিন লাখ টাকার মধ্যেই কোটেশনের মাধ্যমে নিজস্ব কোম্পানি/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে বিল তুলে নেওয়া।

পরিচালকের নির্দেশে প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌসকে দিয়ে ভুয়া চাহিদাপত্র তৈরি করে কোটেশনের মাধ্যমে ক্রয় দেখিয়ে মালামাল না কিনেই অধিকাংশ কোডের টাকা তুলে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।

এ ছাড়া, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অধিকাংশ কোডের টাকা কোনো দরপত্র আহ্বান না করেই কোটেশনে মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, বিলগুলো পর্যালোচনা বা তদন্ত করলে দেখা যাবে কয়েকটি সরবরাহকারী/কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করে অধিকাংশ বিল কোটেশনের মাধ্যমে (২০২৩-২৪ অর্থবছর) তুলে নিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এসব কোটেশন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে (এজি অফিসে) পাঠানো হয়েছে।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার ডায়েরি

২০২৩-২৪ অর্থবছরে কাগজ ও মুদ্রণ সামগ্রী কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সূত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতি বছর ১৩ হাজার ১০০টি করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কৃষি ডায়েরি এআইএস থেকে মুদ্রণ করে সরবরাহ করে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩ হাজার ১০০টি কৃষি ডায়েরি প্রতিটি ২০০ টাকা হারে ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকার প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু পিপিআর-২০০৮ -এর তফসিল-২, পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা: ধারা ৯(২)ক পৃষ্ঠা নম্বর ৬৭০ সরকারি বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কোটেশনের মাধ্যমে ক্রয়ের বিধান রয়েছে।

ডায়েরি মুদ্রণ মালামাল ই-জিপিতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করেই কাগজ ও মুদ্রণ সামগ্রী ছোট ছোট কোটেশন ৩ লাখ টাকার ভেতরে [২০২২- ২৩ অর্থবছরের বিল নম্বর ৫০০ থেকে ৫১৭, টোকেন নম্বর ৫২০৬৫ হতে ৫২০৮২ তারিখ: ২০ জুন ২০২৩ সালে ১৮টি কোটেশনের মাধ্যমে (প্রতিটি কোটেশনে ২ লাখ ৯০ হাজার ৮৯০ টাকা ও ২ লাখ ৯০ হাজার ৪০০ টাকা করে)] ৫২ লাখ টাকার মুদ্রণ সামগ্রী নিজস্ব তিনটি সরবরাহকারীর প্রতিষ্ঠানের প্যাডে দ্বিগুণ দামে সরবরাহ দেখিয়ে ২৬ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে। এসব ডায়েরি ছাপাতে সরবরাহকারীর প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশে কাগজ দেখানো হয়েছে (২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি) ৬১ গ্রাম। দাম ৩ হাজার ৬২ টাকা। অথচ, ডায়েরিগুলোয় কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে (২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি) ৬১ গ্রাম, যার বাজার দর ১৫০০ থেকে ১৫৫০ টাকা।

এ অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে পুরান ঢাকার বাবু বাজারে বাজারদর যাচাই করে বাংলানিউজ। সেখানে দেখা যায়, যে মানের কাগজ ও মুদ্রণ সামগ্রী কোটেশনের মাধ্যমে কেনা হয়েছে সেগুলোর বাজারদর বাস্তবে অনেক কম। এআইএস কাগজ কিনেছে (২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি) ৬১ গ্রামের; যার বাজারমূল্য ১৫০০ থেকে ১৫৫০ টাকা। কিন্তু বিলে দেখানো হয়েছে (২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি) ৬১ গ্রাম। বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৬২ টাকা।

এআইএসের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, এই দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক সুরজিত সাহা রায়, তৎকালীন প্রধান তথ্য অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু জাফর আল মনসুর ও প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস। এই তিন কর্মকর্তার কারণে সরকারের ২৬ থেকে ২৭ লাখ টাকা গচ্চা গেছে।

মুদ্রণ কাজের কাগজ ও কালি সরবরাহে অনিয়ম

কৃষি তথ্য সার্ভিস প্রতি বছর প্রিন্টিংয়ের কাজের বিভিন্ন সাইজের কাগজ ও ৪ কালার কালি দরপত্র আহ্বান করে সরবরাহ করে থাকে। অভিযোগ মিলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২১১১২৮ নম্বর কোডের আওতায় প্রকাশনা (কাগজ ও কালি ক্রয়) খাতে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার মুদ্রণ উপকরণ (কাগজ ও কালি) ই-জিপিতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে ৩ লাখ টাকার মধ্যে কোটেশনের সরবরাহ দেখিয়ে মালামাল কেনা হয়। কিন্তু সেগুলো গ্রহণ না করে দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে নিজস্ব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিল করে টাকা উত্তোলন করে ভাগবাটোয়ারা করেছেন সুরজিতের সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রকাশনা খাতে বরাদ্দকৃত ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকার মধ্যে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলেও পরিচালক সুরজিত সাহা রায় এআইএসের পরিচিত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৫ টাকার কাগজ ও কালি সরবরাহের কাজ দেন।  

অভিযোগ উঠেছে, প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌসের যোগসাজশে যে সাইজে কাগজ, গ্রাম ও পরিমাণ দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে সরবরাহ করার চুক্তি ছিল সেভাবে সরবরাহ না করে গোপন চুক্তির মাধ্যমে এসবের দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে নগদ ৭০ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন সুরজিত ও তার সিন্ডিকেট।

২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর বিল/টোকেন নম্বর ২০৬ ও ৯ নভেম্বর ১৭৪৩০ নম্বর টোকেনে ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৫ টাকায় ২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি ৬১ গ্রামের ৩৫০০ রিম; ২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি ৬১ গ্রামের ১০০ রিম; ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি ৮০ গ্রামের ৮০ রিম; ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি ১০০ গ্রামের ৫০ রিম; ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি ১২০ গ্রামের ১০ রিম; ২৫ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইজি ১০০ গ্রামের আর্টপেপার ৫০০ রিম; ২ পাউন্ড কালির ৫০০ কৌটা; ২ পাউন্ডের ৪ কালারের কালির ৭০ সেটের দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে কোটেশন তৈরি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, পারটেক্স ব্র্যান্ডের কাগজ সরবরাহের কথা থাকলেও রিমের বান্ডিলে কম দামি অন্য ব্র্যান্ডের কাগজ সরবরাহ করেছেন প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস। সংস্থার জন্য কেনা কালি নিয়েও দুর্নীতি করেছেন তিনি।

কৃষি ডায়েরি-২০২৪ ছাপানোয় অনিয়ম

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি তথ্য সার্ভিস ৯ হাজার কপি কৃষি ডায়েরি ছাপানোর কাজ করছে। এ কাজ চলমান। এখানেও ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন সুরজিত ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন। ডায়েরি ছাপানোয় ২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি ৬১ গ্রামের কাগজ ব্যবহার করার কথা। কিন্তু তারা  ২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি , ৬১ গ্রামের কাগজ দিয়ে ডায়েরি ছাপাচ্ছেন। কাগজের রিমের বান্ডিলের বাইরে পারটেক্স ব্র্যান্ড দেখানো হলেও ভেতরে অন্য কমদামি কাগজ দেওয়া হয়েছে। বাড়তি বিল দেখাতে এসব কারসাজি চলছে।

অভিযোগ আছে, রাতের আঁধারে নতুন প্রেস বিল্ডিংয়ের চারতলায় গোডাউনে এসব কাগজ তুলে রাখা হয়েছে। সূত্র দাবি করেছে, উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে চারতলার স্টোর পরিদর্শন করলে এসবের প্রমাণ মিলবে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কৃষি তথ্য সার্ভিসের (প্রেস) স্টোর কিপার ইসরাত জাহান খান বাংলানিউজকে বলেন, আমার কাছে যে রিকুইজিশন আসে সে মোতাবেক চাহিদা অনুযায়ী আমি সরবরাহ এবং গুদামজাত করি। আমি মাপ সংক্রান্ত কোনো কিছুই জানি না।

তিনি এসব বিষয়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

‘ফল সম্ভার বই’ না ছাপিয়ে বিল উত্তোলন

এআইএসের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুন মাসে ফল মেলা উপলক্ষে ‘ফল সম্ভার বই’ ছাপানো বাবদ ২৫ নম্বর বিলে ১২৮ পাতার ৮৯০ কপি বইয়ের জন্য ২ লাখ ৪৮ হাজার ০৮৭; ২৬ নম্বর বিলে ২ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৭ টাকা ও ২৭ নম্বর বিলে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৭৫ টাকাসহ মোট ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৯ টাকা তুলে নিয়েছেন পরিচালক। ২০২৩ সালের ২ জুলাই এ অর্থ তুলে নেন তিনি।

এআইএসের ওই সূত্রের দাবি, তিনটি বিলই ভুয়া। প্রেস ম্যানেজার জান্নাতুল ফেরদৌস, তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (অ্যাগ্রি) মো. আবু জাফর আল মনসুর, ক্যাশিয়ার মো. জুয়েল হোসেন এসব বিলের অর্থ তুলে পরিচালকসহ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। ২০২৩ সালের ২২ জুন ৫৫৯ নম্বর বিলের মাধ্যমে ডিজিটাল পিভিসি স্টিকার প্রিন্ট ও স্ট্র্যাটো তৈরি দেখিয়ে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

এ ব্যাপারে কৃষি তথ্য সার্ভিসে প্রেস ম্যানেজারের খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলতে চায় বাংলানিউজ। উপ-সহকারীর ডায়েরি প্রিন্ট করতে কী মাপের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, দুঃখিত এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।

এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আপনি মনে হয় রিপোর্টিং পারপাসে কিছু তথ্য জানতে চাচ্ছেন। আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আপনি বরং আমাদের ডিরেক্টর স্যারের সাথে কথা বলেন।

পরে কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়ের সঙ্গে কথা বলে বাংলানিউজকে। সংশ্লিষ্ট সব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কৌশলী উত্তরে দেন।

কাগজ কেনায় দুর্নীতির ব্যাপারে তিনি বলেন, না দেখে কাগজের পরিমাপ বলতে পারব না। ডায়েরিতে সম্ভবত ৬১ গ্রামের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। যে ঠিকাদার কোম্পানিকে কাগজ দিতে বলেছিলাম সেই কোম্পানি কাগজের জন্য এলসি খুলতে পারছিল না। তাই এসব কোটেশন করে কাগজ কিনতে বাধ্য হয়েছি।

কোটেশন করতে গিয়ে সরকারের ২৬ লাখ টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে কি না, প্রশ্ন করলে পরিচালক বলেন, না, সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি। সময় মতো ডায়েরি প্রস্তুত করে দিতে হয় বলে কোটেশন করে কাজ করতে দিয়েছি। আমার হাতে ডকুমেন্ট না থাকায় বলতে পারছি না। যারা দায়িত্বে আছেন (প্রেস ম্যানেজার) তারা বলতে পারবেন।

ফল সম্ভার বই না ছাপিয়ে ৯ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন কি না প্রশ্ন করলে সুরজিত তা অস্বীকার করেন। তাদের কাছে ফল সম্ভার বই আছে উল্লেখ করে তিনি এ প্রতিবেদককে কৃষি তথ্য সার্ভিসে এসে সেগুলো দেখে আসার কথা বলেন।

২০২৩ সালে উপসহকারী ডায়েরি তৈরির কোটেশনে দেখানো হয় ২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি কাগজের। কিন্তু ডায়েরিতে ব্যবহার হয় ২০ ইঞ্চ বাই ৩০ ইঞ্চি কাগজের, কেন এমন শুভঙ্করের ফাঁকি? 

উত্তরে এআইএস পরিচালক বলেন, এ বিষয়ে আমি বলতে পারব না। এখানে দায়িত্বে আছেন আমাদের প্রেস ম্যানেজার।

কৃষি সচিব বন্ধু পরিচয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অপেশাদার আচরণের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিচালক সুরজিত সাহা রায় বলেন, সচিব আমার বন্ধু হতেই পারেন। আমি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করি না।

এআইএস পরিচালক সুরজিতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে কি না জানতে কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তারকে কল করে বাংলানিউজ। কয়েকবার তার নম্বরে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।