ঢাকা: ডেমরায় অছিম পরিবহনে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় জড়িত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ বিভাগের এন্টি ইললিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিম। আগুনের এ ঘটনায় আসামিদের ব্যবহৃত গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন- ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম মনির ওরফে মনির মুন্সি (৩৭), নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব মো. সাহেদ আহমেদ (৩৮), বিএনপি কর্মী এবং মনির মুন্সির ব্যক্তিগত গাড়িচালক মাহাবুবুর রহমান সোহাগ (৩৩)।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বানচালের উদ্দেশে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব পরিচালনা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। প্রধান বিচারপতির বাস ভবনে হামলা, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করার মত জঘন্য কাজসহ অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় বিএনপির নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর ভোরে ডেমরা থানাধীন দেইল্লা বাসস্ট্যান্ডে রাখা অছিম পরিবহনের একটি গাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মো. নাইম (২২) ঘটনাস্থলে আগুনে পুড়ে মারা যায় এবং অপর হেলপার মো. রবিউল (২৫) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনায় ২৯ অক্টোবর ডেমরা থানায় একটি মামলা (নাম্বার ৩৮) হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি'র প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ ঘটনার মামলাটি ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর সিটিটিসির স্পেশাল একশন গ্রুপের এন্টি ইলিগাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিমে হস্তান্তর করা হয়। সিটিটিসি এ মামলাটির তদন্ত শুরু করে।
তদন্তের প্রথমেই দুইজন ভুক্তভোগীর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত মো. নাইম (২২) এর বাড়ি বরিশালের কোতয়ালি থানা এলাকায়। নিহত নাইমের বাবার নাম আলম চৌকিদার এবং মায়ের নাম পারভিন বেগম। তারা ডেমরা এলাকাতেই থাকতেন। অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা ফিরানোর জন্যই অল্প বয়সে কাজে নেমে পড়েন। অবশেষে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বাসের ভেতর ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুনে পুড়ে মারা যান।
অপর ভুক্তভোগী মো. রবিউল (২৫) একই বাসে নাইমের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমের মাঝে আচমকা আগুনের তাপে ঘুম ভেঙে যায় তার। কিন্তু ততক্ষণে রবিউলের শরীরেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় গাড়ি থেকে সে বের হয়ে আসে। পরে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে যায়। বর্তমানে তার শরীরে পোড়া দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তিনি বলেন, তদন্তভার গ্রহণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনাস্থলের চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। এসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি গাড়ি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ওই গাড়িটি ওইদিন অগ্নিসংযোগে ব্যবহৃত হয়েছিল। এ গাড়ির সূত্র ধরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মূল অগ্নিসংযোগ কারী ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার এবং ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটি জব্দ করা হয়।
পুলিশের এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায়, গত ২৮ অক্টোবরের ধারাবাহিকতা এবং তাদের এ নাশকতা অব্যাহত রাখার জন্য মনির মুন্সি তার নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পায়। নির্দেশনার মূল বিষয়বস্ত ছিল নাশকতার মাত্রা আরও বাড়ানো এবং এমন কোনো ঘটনা ঘটানো যাতে করে জনমনে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তারই অংশ হিসেবে সে বেশ কয়েকজনকে অগ্নিসংযোগের জন্য নিয়োগ দেয়। সে নিজে বড় একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য তার অপর সহযোগী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিব এবং তার বন্ধু সাহেদ আহমেদকে ডেকে নেয়। তারা দুজনে মিলে একটি পরিকল্পনা করে যেখানে তারা স্থির করে এমন একটি ঘটনা ঘটাবে যাতে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এ পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে ডেমরা এলাকার দেইল্লা বাস স্ট্যান্ড এলাকায় রাত ২টার পর বেশ কয়েকবার গাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে রেকি করে এবং দেখতে থাকে কোন জায়গাটা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতামুক্ত। অবশেষে তারা কাঙ্ক্ষিত টার্গেট ফিক্স করে “বড়ভাঙ্গা” মার্কেটে চলে যায়। সেখান থেকে তারা ২ লিটারের পানির বোতলে পেট্রল সংগ্রহ করে। পরে আনুমানিক ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ঘটনাস্থলে নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার মাহাবুবুর রহমান সোহাগ গাড়িতে অবস্থান করে এবং মনির মুন্সি ও সাহেদ পেট্রলের বোতল নিয়ে রাস্তার পাশে পার্ক করা অছিম পরিবহনের গাড়ির কাছে যায়। সেখানে একটি গাড়ির ড্রাইভার সিটের পাশে থাকা খোলা গ্লাসের অংশ দিয়ে ড্রাইভার সিটে মনির মুন্সি পেট্রল ঢেলে দেয়। একপর্যায়ে বোতলটিও সেখানে ফেলে দেয়। তারপর সে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে সেই কাঠি ঢেলে দেয়া পেট্রলের ওপর ছুড়ে মারে। নিমিষেই আগুন ছড়িয়ে পড়লে তারা দুইজন দৌড়ে পুনরায় গাড়িতে এসে উঠে এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
হামলাকারীরা সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্য সড়কের রং সাইড দিয়ে ডেমরা এক্সপ্রেস ওয়েতে উঠে সুফিয়া কামাল ব্রিজ দিয়ে ভুলতায় থাকা মনির মুন্সিদের মালিকানাধীন “মুন্সি পেট্রল পাম্প” এ রাত্রি যাপন করে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে তারা পেট্রল পাম্প থেকে বাসায় চলে যায়।
তিনি বলেন, এ ঘটনাটি সম্পূর্ণ ক্লু-লেস ছিল। আমরা বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করে ও তদন্ত করে একটি গাড়ি শনাক্ত করি। পরে সেই গাড়ির সূত্র ধরে একে একে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আগুন দেওয়ার জন্য দুই লিটারের একটি পানির বোতলে করে তাদের একটি মোটরসাইকেল থেকে পেট্রল সংগ্রহ করেছে সেটিও জব্দ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মনির মুন্সি নির্দেশদাতাদের থেকে নির্দেশনা পেয়ে এ কাজ শুরু করে। সে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে চেয়েছে। সে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। সে দলের আরও বড় পোস্ট পাওয়ার প্রত্যাশায় ছিলনে।
এ ঘটনার নির্দেশদাতাদের শনাক্ত করা হয়েছে কী না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নির্দেশদাতাদের নাম আমারা পেয়েছি৷ তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। আমরা তাদেরও গ্রেপ্তার করবো। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের বিষয়ে এখনই কোনো তথ্য আমরা বলবো না।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
এসজেএ/জেএইচ